ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আগামী দিনের যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আগামী দিনের যুদ্ধ

গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রে- রাষ্ট্রে যুদ্ধ অতি কদাচিতই হয়েছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ আদৌ হয়নি। যুদ্ধ না হওয়ার কারণ প্রধানত পরস্পরের পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা এবং যুদ্ধ ও হানাহানির প্রতি অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ সমাজগুলোর তাড়না কমে যাওয়া। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘাত বা গৃহযুদ্ধ অসংখ্য চলছে। সেগুলো চলছে বিশেষভাবে ব্যর্থ বা ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোতে। সচরাচর সেগুলো হয়েছে এবং হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যার স্ফীতি এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত উগ্রবাদের কারণে এ ধরনের যুদ্ধ অব্যাহত। এ ধরনের যুদ্ধ ক্রমবর্ধমান হারে চলবে শহরাঞ্চলে। কারণ ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী শহরে বাস করবে। প্রতি বছর প্রায় ৮ কোটি লোক গ্রাম থেকে শহরে আসছে। আলেপ্পো ও মসুলের সাম্প্রতিক লড়াই থেকে প্রমাণ হয়েছে শহুরে যুদ্ধ কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশা ও যন্ত্রণাকর হতে পারে। প্রযুক্তি শহুরে যুদ্ধ ও অন্যান্য যুদ্ধের চেহারা বদলে দেবে। তার পরও এই যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য হবে কাছাকাছি লড়াই, মহল্লায় মহল্লায় যুদ্ধ। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে পুরোদস্তুর আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের সম্ভাবনা না থাকলেও অপেক্ষাকৃত কম তীব্র রূপের সামরিক প্রতিযোগিতার সুযোগ এখনও আছে। বিশেষ করে সেখানে চীন ও রাশিয়া এখন আর আন্তর্জাতিক পরিসরে আমেরিকার আধিপত্য মানতে রাজি নয়। দুটো দেশই দেখিয়েছে যে নিজেদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে তারা সামরিক শক্তি প্রয়োগে প্রস্তুত। রাশিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন এবং চীনের ক্ষেত্রে বিরোধীয় সমুদ্র এলাকায় কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ তার দৃষ্টান্ত। চীন ও রাশিয়ার লক্ষ্য এখন আমেরিকার হস্তক্ষেপকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল করে তোলা। বৃহৎ শক্তিগুলো সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যবর্তী ‘গ্রে জোনকে’ কাজে লাগাতে চায়। গ্রে জোন কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধে না গিয়েও রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সুফল অর্জন করা যা সামরিক আগ্রাসনের দ্বারাই হয়ে থাকে। ‘গ্রে জোন’ আসলে এক ধরনের হাইব্রিড বা সংকর যুদ্ধ, যার মধ্যে সামরিক অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, গোয়েন্দা ও অপরাধ কার্যক্রম সবই মিশে আছে। নতুন নতুন অস্ত্র বৃহৎ শক্তিবর্গ ঠিক সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের যে চেষ্টা করবে তার প্রধান কারণ এখনও পারমাণবিক হুমকি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় করে সেই ভীতিকর ভারসাম্য অতীতের মতোই স্থিতিশীল থাকবে। রাশিয়া ও আমেরিকা বিপুল অর্থ ব্যয়ে তাদের পারমাণবিক শক্তির আধুনিকায়ন ঘটেছে। চীনও তার পরমাণু অস্ত্র ভা-ার বাড়িয়ে তুলেছে। তবে চীন ও রাশিয়ার এখন ভয় হলো, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বদৌলতে আমেরিকা প্রথমেই পারমাণবিক আঘাত হানার আশ্রয় না নিয়েও তাদের পরমাণু অস্ত্র ভা-ার বিপন্ন করে তুলতে পারে। গত এক দশক ধরে আমেরিকা কনভেনশনাল প্রম্পট গ্লোবাল স্ট্রাইক (সিপিজিএস) অস্ত্র তৈরির জন্য কাজ করে চলেছে। যদিও এমন অস্ত্র এখনও মোতায়েন করা হয়নি। এই কর্মসূচীর লক্ষ্য হচ্ছে, অতিমাত্রায় নির্ভুলতার সঙ্গে হাইপারসোনিক গতিতে অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে অন্তত ৫ গুণ বেশি গতিতে অতি ঘনভাবে সুরক্ষিত আকাশ পথ দিয়ে লক্ষ্যবস্তুর ওপর প্রচলিত বোমার আঘাত হানা। চীন ও রাশিয়া বলেছে যে, উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে এই অস্ত্র ছোড়া হলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে। অবশ্য তারাও একই ধরনের অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘাতক রোবট পরমাণু অস্ত্রের ছায়ার নিচে বাস করতে কেমন লাগে, তা অন্তত বিশ্ববাসীর জানা। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এখন হলো- কৃত্রিম বুদ্ধি ও ডিপ লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে যেরূপ দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যত যুদ্ধ এমনকি সেই যুদ্ধ সম্পর্কিত ভাবনার ওপর কোন প্রভাব এসে পড়বে। একটা বড় উদ্বেগের ব্যাপার হলো- এই প্রযুক্তগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন অস্ত্র তৈরি করতে পারে যে, সেগুলো যারা সৃষ্টি করল বা নিয়োগ করল তাদের থেকে স্বাধীনভাবে মানুষ হত্যার ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঘাতক রোবট তৈরি বন্ধ করার এক আন্তর্জাতিক অভিযান এখন চলছে যার লক্ষ্য হচ্ছে মারাত্মক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালু হতে পারার আগেই সেগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়া। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আসন্ন প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এই সংক্রান্ত এক চিঠিতে ২০১৫ সালে স্বাক্ষর করেছিলেন স্টিফেন হকিং, এলোন মুস্ক ও ডেমিস হাসাবিসসহ এক হাজারেরও বেশি কৃত্রিম বুদ্ধি বিশেষজ্ঞ। ভবিষ্যতে এই কৃত্রিম বুদ্ধি এবং সেই বুদ্ধি নির্ভর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার ব্যপারে মানুষকে বেশ বেগ পেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বৃহৎ শক্তির মধ্যে যদি যুদ্ধ লাগে গত ৭০ বছরে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রায় হ্রাস পেলেও অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা বিশ্ব এমন এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে যেখানে এমন যুদ্ধের সম্ভাবনা আবারও দেখা দিচ্ছে। তাদের মতে পারমাণবিক যুদ্ধে না গড়ালেও পাশ্চাত্যের সঙ্গে রাশিয়ার কিংবা চীনের পুরোদস্তুর যুদ্ধ হতে পারে। তারা মনে করেন অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় এখন সেই সম্ভাবনা এতটা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ রাশিয়া ও চীন উভয়েই অসন্তুষ্ট ও অপরিতৃপ্ত শক্তি, যারা পাশ্চাত্যের উদ্ভাসিত শর্তাবলী পরিবর্তন করে আমেরিকার মোরলিতে পরিচালিত বিশ্ব ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে এবং এভাবে নিজেদের সার্থকে আরও ভালভাবে এগিয়ে নিতে চায়। নিজেদের প্রভাবালয় বাড়াতে কিংবা আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে এই দেশ দুটি নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক আধুনিকায়ন ঘটিয়েছে এবং প্রতিবেশীদের ওপর নিজেদের ইচ্ছা গায়ের জোরে চাপিয়ে দিতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে তফাত হলো রাশিয়ার শক্তি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে চীন উদীয়মান শক্তি। সময়টা তার অনুকূলে এবং নিজেকে সে আমেরিকার চেয়ে উন্নত না ভাবলেও সমান বলে মনে করে। আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর কোন তুলনা না হলেও রুশ সামরিক বাহিনীর উল্লেখযোগ্য আধুনিকায়ন চলছে। এই বাহিনী ঘন ঘন বড় আকারের মহড়া করছে এবং ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বড় ধরনের লড়াইয়ের সক্ষমতা লাভ করেছে। প্রতিবেশী লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার রাজধানীতে পৌঁছতে রুশ বাহিনীকে বড়জোর ৬০ ঘণ্টার লড়াই করতে হবে। অন্যদিকে কোন কোন বিশ্লেষকের বক্তব্য হলো, চীন ও আমেরিকা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য। গ্রাহাম এলিসন নামে এমন এক বিশেষজ্ঞ বলেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ যে সম্ভব তাই শুধু নয়, বর্তমানে যেভাবে ভাবা হচ্ছে, তার চেয়ে সেই সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বড় ধরনের যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি রাশিয়ার তুলনায় কম। তাই বলে সেটা তুচ্ছ বলে মনে করার কারণ নেই, বরং সেই ঝুঁকি ক্রমশ বাড়তে পারে। গ্রে-ওয়ারফেয়ার আধুনিক যুদ্ধের এক নতুন রূপ গ্রে-জোন ওয়ারফেয়ার। একে হাইব্রিড বা সংকর যুদ্ধও বলা হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, গ্রে-জোন বা হাইব্রিড যুদ্ধের আধুনিকতম রূপের প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে নানা ধরনের কৌশল একত্রে কাজে লাগানো হয়। যেমন অত্যাধুনিক প্রচার-প্রচারণার দ্বারা স্থানীয় জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা ও তারপর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণকে বৈধ রূপ দান করা। এ ছাড়া সাইবার হামলার দ্বারা বিদ্যুত গ্রিড ও গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করা, এমন গোপন তৎপরতা চালান যার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা যায়। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নতাকামী অনিয়মিত বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সহায়তা যোগানো। এমনকি দরকার হলে সীমিত পরিসরে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা বা ব্যবহারের হুমকি দেয়া। ঘরে ঘরে যুদ্ধ ভবিষ্যতের লড়াই বেশিরভাগ শহরাঞ্চলে হওয়ারই সব থেকে বেশি সম্ভাবনা। এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে অনেকগুলো মেগাসিটি গড়ে উঠছে যেগুলোর এক একটির লোকসংখ্যা ১ কোটি কি আরও বেশি। এগুলোর চার পাশে অনেক সময় থাকে ঘন সংবদ্ধ বস্তি, সেগুলো মহল্লার গ্যাংগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভবিষ্যতে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো ও তাদের প্রতিপক্ষতা এ ধরনের শহরাঞ্চলেই লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। অনেক ক্ষেত্রে ঘরে ঘরে ও হাতাহাতি যুদ্ধ হবে। বোমবর্ষণ, কামান ও মর্টারের হামলা সে যুদ্ধকে ভয়ঙ্কর করে তুলবে। ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার আলেপ্পো এর দৃষ্টান্ত। তথ্যের ক্ষেত্রে আধিপত্য আগামী দিনের যুদ্ধের একটা দিক হলো তথ্যের ক্ষেত্রের আধিপত্য অর্জন। চীন এখন আমেরিকার সমুদ্রভিত্তিক ও স্থলভিত্তিক বিমান শক্তির আধিপত্য ক্ষুণœ করার এবং এর মাধ্যমে দেশটির যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা সীমিত করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারই প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে তথ্যের ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন। তার অর্থ আমেরিকার ডাটা ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলোকে টার্গেট করা, সেগুলোকে লেজার দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা এবং এর পাশাপাশি কম্পিউটার ব্যবস্থার ওপর সাইবার আক্রমণ চালানো। চীনের উপকূলের কাছাকাছি আমেরিকাকে তৎপরতা চালাতে না দেয়ার জন্য প্রয়োজনের মুহূর্তে একই সঙ্গে চীনের স্থলভাগ থেকে নিক্ষিপ্ত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র, দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্র নৌযান, ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন ও সামুদ্রিক জঙ্গী বিমান মার্কিন রণতরীসমূহ এবং গুয়াম ও জাপানে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাবে। চীনের লক্ষ্য হচ্ছে, মার্কিন বিমানবাহী রণতরীগুলোকে তাদের নতুন এফ-৩৫ স্টিলথ বিমানের মতো জঙ্গী ও বোমারু বিমানের রিফুয়েলিং রেঞ্জের বাইরে ঠেলে দেয়া কিংবা জাহাজ বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রণতরীর ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করা। ডিএফ-২১ডি নামের এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ‘বিমানবাহী রণতরী ঘাতক’ হিসেবে পরিচিত। এগুলো সড়কপথেও পরিবাহিত হতে পারে। এর পাল্লা ১ হাজার মাইলের বেশি এবং এতে প্রচলিত বোমাও লাগানো যেতে পারে। এর পাশাপাশি চীন গভীর সমুদ্রে চলাচল উপযোগী শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী বহরও গড়ে তুলছে। বলাবাহুল্য, চীনের এ জাতীয় হুমকি ঠেকাতে আমেরিকাও চুপ করে বসে নেই। তারা স্বয়ংক্রিয় লার্নিং সিস্টেম, মানব-মেশিন সহযোগিতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নির্ধারণ, উন্নত ধরনের মানববাহী বা মানবহীন বিমান পরিচালনা, নেটওয়ার্কভুক্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও উচ্চগতির প্রজেক্টাইল ব্যবহারের স্ট্র্যাটেজির ওপর জোর দিচ্ছে। এসব কিছুই ভবিষ্যতের যুদ্ধের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আকাশে আমেরিকা তার নিজস্ব সিস্টেম ও কন্ট্রোল ব্যবস্থার দ্বারা প্রতিপক্ষের ইন্টিগ্রেটেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর (আইএডিএস) ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করতে পারে। তারপর নেটওয়ার্কভুক্ত ছোট ছোট মানবহীন এরিয়ান ভেহিকেল (ইউএভিএস) ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠিয়ে আরও বেশি ক্ষতি সাধন করতে পারে। শেষে নিয়োগ করা হতে পারে বি-২ এবং নতুন বি-২১ এর মতো দূরপাল্লার স্টিলথ্ বোম্বার। তবে আমেরিকা স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে এ ধরনের যে শ্রেষ্ঠত্ব ভোগ করে আসছিল, তা এখন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা অধিক থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সেটা অর্জনের নতুন নতুন কৌশলের মধ্যে থাকবে রাডার ফাঁকি দেয়ার স্টিলথ প্রযুক্তি, শত্রুর আক্রমণ থেকে মহাকাশভিত্তিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক রক্ষা, ফাঁদ পেতে রাখা এবং আগত ক্ষেপণাস্ত্রের হাত থেকে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা। দৃষ্টান্তস্বরূপ শত্রু ভূখ-ের উপকূলের কাছে ছেড়ে দেয়া ঝাঁক ঝাঁক ইউএভির গায়ে লাগানো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক অস্ত্র (ইএমডব্লিউ) প্রতিপক্ষের সেন্সর ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দেয়া সম্ভব। জাহাজের ওপর বসানো ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেল গান বোমাসজ্জিত শত্রুর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে আকাশপথে ঘণ্টায় সাড়ে চার হাজার মাইল গতিতে প্রোজেকটাইন ছুড়তে পারে। পরমাণু অস্ত্রের হুমকি থাকছেই পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার পরস্পরের ধ্বংস ডেকে আনবে- এ নিশ্চয়তাই এতদিন পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোকে এই অস্ত্র ব্যবহারে বিরত রেখেছে। কিন্তু সেটা আর কতদিনের জন্য? আমেরিকা ও রাশিয়া দুটো দেশই পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বহুলাংশে কমিয়েছে সত্য, তবে তারা তাদের স্ট্র্যাটেজিক পরমাণু অস্ত্র আধুনিকায়নের দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। রাশিয়া শীঘ্রই সড়কে ভ্রাম্যমাণ আইসিবিএম মোতায়েন করতে যাচ্ছে। তেমনি মোতায়েন করছে নতুন ভারি আইসিবিএম, ৮টি নতুন ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন। আপগ্রেড করা হচ্ছে ভারি বোম্বারগুলো এবং হাইপারসোনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম এক নতুন স্টিলথ বোম্বার। আমেরিকাও একই কাজ করে চলেছে। পরমাণু অস্ত্রধর অন্যান্য দেশ যেমন- চীন, ভারত, পাকিস্তান, বিশেষত উত্তর কোরিয়া তাদের অস্ত্রের আকারগত ও গুণগত মানোন্নয়নে কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার পরও এ পর্যন্ত রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র আছে ৭ হাজার, আমেরিকার ৬ হাজার ৮০০, ফ্রান্সের ৩শ’, চীনের ২৭০, ব্রিটেনের ২১৫, পাকিস্তানের ১৪০, ভারতের ১৩০, ইসরাইলের ৮০ ও উত্তর কোরিয়ার ১০টি। পরস্পরের ধ্বংস ডেকে আনার আশঙ্কাই এতদিন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার ঠেকিয়ে রাখলেও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের যেরূপ অবনতি ঘটে চলেছে, বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে তাতে ভবিষ্যতে যুদ্ধ লাগার ও সেই যুদ্ধের কোন এক পর্যায়ে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সূত্র : টাইম
×