ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’

অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বাংলাদেশে হাজারো মেলার মাঝে বইমেলার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে মূলত এ মেলাকে কেন্দ্র করে। বাঙালীর ভাষা, সাংস্কৃতি বোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে বই মেলার ভিত্তি। লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের কাছে অমর একুশে বইমেলা এক সেরা উৎসব। সবারই মিলন মেলা বাংলা একাডেমির বইমেলা। এদেশের সকল শ্রেণীর পাঠক সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বসবে অমর একুশে বইমেলা, কবে বসবে বাঙালীর মিলন মেলা। ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি আর একুশের বইমেলা একই সূত্রে গাঁথা। একুশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ফসল বাংলা একাডেমি। একুশে বইমেলা বিকশিত হয়েছে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে। নবগঠিত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক জাগরণের প্রথম প্রকাশ অমর একুশে বইমেলা। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ দিন একুশে ফেব্রুয়ারি কে ঘিরে রয়েছে বাঙালীর দীর্ঘকালের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের এই মাসেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রস্তুত হচ্ছিল ছাত্রজনতা। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সমর্থন দিয়েছিল আপামর বাঙালী। দিন যত যেতে থাকে ভাষা আন্দোলন তত গতি পেতে থাকে। বায়ান্নর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। গড়ে তুলেছিল প্রবল প্রতিরোধ। শুরু করেছিল আমরণ সংগ্রাম। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষায় রূপ দিতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল অনেকে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পর থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। দিনটি পালিত হতে থাকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, ব্যাপক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। একই বছর ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভাষাশহীদ দিবসের মর্যাদা। বেগবান হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য; একুশে ফেব্রুয়ারি হয় বিশ্বনন্দিত। ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে একুশের গ্রন্থমেলাও এক নতুন ধারায় প্রবেশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশের গ্রন্থমেলা একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী মধ্যবিত্তের কাছে বইমেলা ততদিনে মাসব্যাপী একটি উৎসবে রূপ পেয়েছে। তবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে মেলার বারোয়ারি রূপটি এতটাই প্রকট হয়েছিল যে স্টলগুলো থেকে উচ্চস্বরে বাজানো কবিতা ও গানের ক্যাসেটে কান পাতা দায় ছিল। ভেঁপু-বাঁশির সুর শোনা যেত টিএসসি কিংবা দোয়েল চত্বরে পৌঁছার আগেই। পুরো শাহবাগ থেকেই শুরু হয়ে যেত শিল-পাটা থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের পসরা। সম্ভবত ১৯৯৭ সালে বইমেলা কে শুধুই বইয়ের মেলায় রূপান্তরের একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বাংলা একাডেমির সেই সময়কার মহাপরিচালকের উদ্যোগটা সফল করতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আমিও ঠিক ওই বছর বইমেলা প্রতিবেদন লিখে ভোরের কাগজে চাকরি পাওয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। মনে আছে বাংলা একাডেমির ছোট্ট চত্বরেই সেবার বইমেলাটি বেশ বড় লাগছিল। মেলা শুরুর দু-চার দিনের মধ্যেই আমি একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল কোকিলেরও ডাক শোনা যায়। মহান ভাষা আন্দোলনের স্বাক্ষর হিসেবে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলবে একুশের বইমেলা। এ মাসটির জন্যই যেন পুরো একটি বছর অপেক্ষা করে দেশের ভাষাপ্রিয় মানুষ। লেখক, প্রকাশকরাও একুশের মেলায় তাদের শ্রেষ্ঠ বইটি উপহার দিতে নিরন্তর কাজ করে যান। একুশের গ্রন্থমেলায় বিভিন্ন স্টলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশের প্রবীণ-নবীন লেখকের নানা ধরনের বইয়ের পসরা বসে। মেলায় সমবেত হন বাংলাদেশের বাংলাপ্রেমী লেখক, পাঠক। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তারপরও স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা বায়ান্নর আত্মত্যাগের অভিযাত্রার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি; বরং ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি আমাদের বাঙালীর ঐতিহ্য, কৃষ্টি। পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে আমাদের অর্জিত গৌরবও অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলার চেয়ে ইংরেজী ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী নতুন প্রজন্ম। বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্রে তাদের উৎসাহ কম। বছর ঘুরে আবার এলো বাঙালীর প্রিয় মাস ফেব্রুয়ারি; শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবার মেলায় আগেই প্রকাশকদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের নির্ধারিত স্টল বা প্যাভিলিয়ন। অমর একুশের গ্রন্থমেলার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বাংলা একাডেমির চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অবধি বিস্তৃত হয়েছে। অমর একুশের গ্রন্থমেলাকে এ অবস্থায় পৌঁছতে পেরোতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেকালের বর্ধমান হাউস আজকের বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরা চটের ওপর চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত আজকের মুক্তধারা প্রকাশনী কলকাতা থেকে আনা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা মাত্র ৩২টি বই নিয়ে যে একুশে বইমেলার শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ অনেক বিস্তৃত। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করে একুশের বইমেলার ধারা অব্যাহত রাখে এবং ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে, যা উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রকাশকদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে একুশের বইমেলার আয়োজন করা হয় এবং ১৯৯৭ সালের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মহান একুশের বইমেলা আজকের স্বকীয়তা নিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। এবার একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হওয়ায় এর ব্যাপকতা সব বাংলা সাহিত্যপ্রেমীর মনে আশার সঞ্চার করেছে। শুরু হওয়ার পর থেকে অমর একুশে বইমেলা আপামর বাঙালীর কাছে প্রাণ জোয়ার সৃষ্টিকারী এক মেলায় পরিণত হয়েছে। বাঙালী লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকদের কাছে বইমেলা এক মিলন মেলা। বইমেলায় জড়ো হতে থাকে দূর-দূরান্তের চেনা মুখগুলো। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি পার হলে ভাঙে এ মিলন মেলা। বইমেলা আমাদের অন্তরে যে বন্ধন তৈরি করে তা ভাঙে না কখনই। দেশের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরণা যোগায়। বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে অমর একুশে বইমেলা আবার কবে ফিরে আসবে এই অপেক্ষায়। লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী [email protected]
×