ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

ইতিহাসের শিক্ষা এবং আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ইতিহাসের শিক্ষা এবং আগামীর বাংলাদেশ

আবহমানকাল ধরে বাঙালীর সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যে সৃজনশীল ধারা সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ঘটে গেছে গণহত্যার মতো বিকৃত ঘটনা, যা ছিল বাঙালী জাতিসত্তাকে নির্মূল করার গভীর ষড়যন্ত্র। পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছিল সেই ষড়যন্ত্রের ছক। বাঙালীরা যে শেকড়ের ওপর ভর করে তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রতিভাদীপ্ত যাত্রা শুরু করেছিল তাতে বিরাম চিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছিল পাকহানাদার ও তার দোসররা। এই গণহত্যার ইতিহাস রচিত হয়েছিল মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে। সেখানে ইংরেজ বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল মীর জাফর ও বিশ্বাসঘাতকরা। সেদিন রক্ত ঝরেছিল বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার। বিপন্ন হয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতা ও স্বাধীন সত্তা। ইতিহাসের সেই ধারা অব্যাহত রেখে আবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রচিত হয়েছিল ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। একইভাবে সেদিন পাকিস্তানের দোসররা হত্যা করেছিল মেধাবী বাঙালীদের। বাঙালী জাতি যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন বাঙালীর শিক্ষা, সাহিত্য, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতি, ভাষা, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও রাজনীতির শেকড় উপড়ে ফেলার অপচেষ্টায় ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এই গণহত্যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের গতানুগতিক গণহত্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদি বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান শতাব্দী পর্যন্ত যে গণহত্যাগুলো ঘটেছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সাধারণ জনগোষ্ঠী। কিন্তু এই ক্ষেত্রে হানাদার আর তার দোসররা পরাজয়কে দেখতে পেয়ে সৃজনশীল, মুক্তমনা শিক্ষক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বেছে বেছে হত্যা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে চিন্তাশীল শক্তির প্রয়োজন ছিল তাকে নির্মূল করা। যদি এই প্রথিতযশা বাংলার সৃষ্টিশীল সন্তানদের হত্যা করা না হতো তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মতো জঘন্য ইতিহাস সৃষ্টি হতো না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ক্ষেত্রেও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা একই পন্থা বেছে নিয়েছিল। যদি গভীরভাবে বিষয়টিকে চিন্তা করা হয় তবে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা হলো স্বাধীন বাংলাদেশকে কোন এক সময় আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা। যদি বুদ্ধিজীবী হত্যা না করা হতো তবে বাঙালীর ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর হত্যাকা- ঘটে। এরপর হানাদার ও তার দোসরদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইতিহাসের পরিক্রমা শুরু হয়েছিল। বিকৃত হয়েছিল ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার ইতিহাসের। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীনতার সূত্রপাত ঘটেছিল। ফলে অসাম্প্রদায়িক, উদারমনা বাঙালীর মধ্যে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছিল। বিপন্ন হয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতার গৌরবজনক ইতিহাস। তাই কোনভাবেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে জাতীয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা আজ বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এখনও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিভিন্নভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ সেই ষড়যন্ত্রকারীরা আত্মগোপন করে আছে। শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে সেই সুপ্ত ষড়যন্ত্রকারীদের বের করে আনা দরকার। সময় কথা বলে, ইতিহাস থেকে যায়। ॥ দুই ॥ ‘স্বাধীনতা’ একটি শব্দ নয়, এটি একটি বিশাল অর্জন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষ পেতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর। এক্ষেত্রে গান্ধীজী বেছে নিয়েছিলেন অহিংস নীতিকে। কিন্তু নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে পথ ও মত ভিন্ন হলেও ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল। এই ভারতবর্ষে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে হাজার বছর ধরে যে জনগোষ্ঠী তার স্বাতন্ত্র্যবোধকে জাগ্রত রেখেছিল তারা হলো বাঙালী জাতি। বারবার বাঙালী জাতিকে খাঁচায় বন্দী করে পরাধীন করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার বিদ্রোহে-বিপ্লবে জেগে উঠেছে বাঙালী জাতি। যে জাতির জাতিসত্তা, জীবনাচরণ, ইতিহাস ও সাহিত্য রচিত হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলায়, প্রথমে সেই ভাষার ওপর আঘাত আসে। প্রতিবাদী বাঙালী রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনে বাংলা ভাষার মর্যাদা। এরই ধারাবাহিকতায় কিংবদন্তির কালজয়ী নেতৃত্ব নিয়ে যে মহানায়কের জন্ম হয়েছিল তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এই স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালী জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ কালরাতে যে গণহত্যা ঘটেছিল তা বাঙালীর জাতিসত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিল। শুরু হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের পর বাঙালী পেয়েছিল স্বাধীন একটি দেশ। আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। তবে ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিজয় দিবসের সেই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে আজকের বাংলাদেশ দেখছে আগামীর স্বপ্ন। ভিশন ২০২১ ও ভিশন ২০৪১ সামনে রেখে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে বিস্তৃত করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে। তবে মাঝে মাঝে জঙ্গীবাদের কুশীলবরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন। এই বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গীবাদীদের কোন স্থান হবে না এটাই জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা। কেননা জঙ্গীবাদীদের কোন ধর্ম নেই। সন্ত্রাসই এদের ধর্ম। আধুনিক ও উন্নত চিন্তাধারার বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই জাতীয় বিজয় দিবসের উদ্দেশ্য সফল হবে। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হলেই বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। তবে এক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিগত ধ্যান-ধারণাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সকলেই সেই প্রত্যাশিত দিনের প্রতীক্ষা করছে। ॥ তিন ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামে এক মহাকাব্যের। এই মহাকালের মহাকাব্যের ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের ০৪ (চার) মূলনীতিকে ধারণ করে। এই আলোক উদ্ভাসিত মূলনীতির পিছনে কাজ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেইদিন থেকে বাস্তবতায় রূপ নিয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। এই ০৪ (চার) মূলনীতি হচ্ছে : ক) বাঙালী জাতীয়তাবাদ, খ) গণতন্ত্র, গ) সমাজতন্ত্র ও ঘ) ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিরায়ত ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এই চার মূলনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব দর্শন ও ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে বাংলার সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ তিনি তাঁর ভাবনায় ব্যাখ্যা করেছিলেন জাতির আবেগের প্রতিবিম্বরূপে। এই জাতীয়তাবোধ সার্বজনীনভাবে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আলোড়িত হয়েছিল সকল মানুষের চেতনার উন্মেষরূপে। এই বোধ ছিল মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার অমিত শক্তির উৎস। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম, চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমে এই শক্তি উৎসারিত হয়েছিল জনমানুষের মননশীলতায়। গণতন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সদ্যস্বাধীন মানুষের মুক্তির আস্বাদন হিসেবে যেখানে মানুষ তার নায্য অধিকার পাবে সুশাসন ও সোনার বাংলার আলোসিক্ত পরিম-লে। সমাজতন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু গতানুগতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের সমাজতন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন বাঙালী জাতিসত্তার ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে সমতা ও সম্পদের সমবণ্টনের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হবে। শোষিত ও শাসকের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাকে নির্মূল করার মৌলিক চিন্তাশক্তি এতে কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধু ধর্মকে দেখেছিলেন তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারিত ধারায়। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকৃতপক্ষে ধর্মহীনতা নয়। বরং এটি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ। এজন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাবনায় ও দর্শনে ধর্মকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে “ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং প্রত্যেক মানুষের তার ধর্ম পালনের অধিকার থাকবে।” কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার মতো গভীরতম চেতনাবোধকে বিসর্জন দিয়ে আজ বাংলার মানুষ ধর্মান্ধ ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর আতঙ্কের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রত্যাগমনই মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে। কেননা মানুষ তার ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো পালন করবে, আবার অন্য ধর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলবে। এতে প্রত্যেক ধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা জাগ্রত হবে। জাতি হিসেবে এটিই আমাদের আকাক্সক্ষা। সেই আলোকিত দিনটির প্রতিক্ষায় আছে সবাই, যেদিন উন্নয়নের ধারা আমাদের ধরনীতে আশীর্বাদরূপে নেমে আসবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×