ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্ন ফাঁসের বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রশ্ন ফাঁসের বাণিজ্য

সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শত উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। চলমান এসএসসি পরীক্ষায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবার সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে ১৬ লাখ পরীক্ষার্থী। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দুটো পরীক্ষায়ই ফাঁস হয়েছে প্রশ্নপত্র। আরও যা অবাক ব্যাপার তা হলো, শতভাগ কমনের নিশ্চয়তা দিয়ে ‘বোর্ডের প্রশ্নফাঁস ব্যাংক’ শীর্ষক ফেসবুক আইডি থেকে হাতে লেখা উত্তরসহ ফাঁস করা হয়েছে প্রশ্নপত্র। একই ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকা, বগুড়া ও অন্যান্য স্থান থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়ই হচ্ছে এসব কা-কারখানা, যা নিয়ে রীতিমতো বিস্ময় এবং হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা সচিব। শিক্ষামন্ত্রী প্রথমদিকে অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সত্যি বলতে কি, গত কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে এসব। পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা, এমনকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাসহ প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সর্বাধিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায়। এতে স্বভাবতই সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা বেশ হতাশ, বিব্রত এবং অসহায় হয়ে পড়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয় সরকার। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্রের মোড়ক খোলাসহ পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা পূর্বে কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। সাতদিন আগে থেকে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয় কোচিং ও গাইড সেন্টারগুলোকে। প্রয়োজনে ফেসবুক বন্ধের কথা বলা হলেও পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত সকলই গরল ভেল। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিড়ম্বনা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অতঃপর সংশ্লিষ্টরা দিশেহারা হয়ে বলছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্র বা উপজেলা থেকে প্রশ্নপত্র নেয়ার দায়িত্বে থাকা কোন অসাধু শিক্ষক অথবা ব্যক্তি প্রশ্নের প্যাকেটের সিলগালা খুলে মোবাইল ফোন বা অন্য কোন প্রযুক্তির সাহায্যে তা পাচার করে দিচ্ছে বাইরে। এটিও অনুমানভিত্তিক। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার আগেই পাওয়া যাচ্ছে প্রশ্নপত্র। একেবারে উত্তরপত্রসহ! বাকি রইল পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে অনলাইনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পাঠানোসহ তাৎক্ষণিকভাবে প্রিন্ট করে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ। তাতেও অবশ্য হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসলে শিক্ষার সর্বস্তরে, একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে নি¤œস্তর পর্যন্ত যদি ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকে তাহলে সেই প্রেতাত্মা তাড়াবে কে? অতঃপর প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি প্রধানসহ জড়িতদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা গেছে। তবে এতেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা, নিকট অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ধরপাকড়সহ যৎসামান্য শাস্তি হলেও উৎসস্থল তথা আসল ‘নাটের গুরুরা’ থেকে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বরং যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা অনতিবিলম্বে জামিনে বেরিয়ে গেছে আইনের ফাঁকফোকড়ে। প্রশাসনিক শাস্তিও প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্তরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-অবস্থা। এনসিটিবি কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে শুরু করে মুদ্রণ, সরবরাহ, নোট ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা, কোচিং বাণিজ্য, সর্বোপরি প্রতিবছর পরীক্ষা গ্রহণের নিমিত্ত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-ফাঁস-খাতা দেখা তথা মূল্যায়ন পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন তথা ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাজধানীসহ সারাদেশে এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে সুবিশাল একটি স্বার্থান্বেষী চক্র তথা ব্যবসায়ী শ্রেণী। সরকারের লোকজনও এর প্রবল অংশীদার। শিক্ষায় নীতি-নৈতিকতা ও মান বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় প্রশ্নফাঁস ঠেকানো আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র!
×