ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে ১৫ হাজার বিঘা কৃষিজমি

সিরাজগঞ্জে যত্রতত্র ৫০ ইটভাঁটি

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সিরাজগঞ্জে যত্রতত্র ৫০ ইটভাঁটি

স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ ॥ রায়গঞ্জ উপজেলার ইটভাঁটিগুলো গিলে খাচ্ছে হাজার হাজার একর উর্বর আবাদী জমির মাটি ও কাঠ। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে অনুমোদনবিহীন ৫০টি ইটভাঁটিতে ব্যবহৃত হচ্ছে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অসংখ্য ট্রাক। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা রাস্তা, সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব, ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। এছাড়া প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ইটভাঁটিতে অবাধে কাঠ ও ফলজ গাছ কেটে পোড়ানো হলেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে রায়গঞ্জ উপজেলাতেই নতুন পুরাতন মিলে ৫০টি ইটভাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালেই গড়ে উঠেছে ১৬টি নতুন ভাটা। এসব ভাটার মধ্যে নামমাত্র কাজগপত্র রয়েছে মাত্র ২৪টির। বাকি ২৬টি রেজিস্ট্রেশনসহ বৈধ কাগজপত্র নেই। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, কৃষি অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশল অধিদফতর, আয়কর বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে অবাধে ব্যবসা করে যাচ্ছেন প্রভাবশালী ভাঁটি মালিকরা। ফলে মোটা অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার একর কৃষি জমি, কমে যাচ্ছে ফসলী জমির পরিমাণ, সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্যশস্যের, উজাড় হচ্ছে ফলজ ও ওষুধি গাছ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঁটির কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী জানান, পরিবেশ অধিদফতর, আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে চলছে এসব ভাঁটির কার্যক্রম। এসব ভাঁটি থেকে মাটি ও ইট বহনকারী বৈধ কাগজবিহীন ট্রাক ব্যবহৃত হচ্ছে। ড্রাইভিং সনদবিহীন, অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ চালকের কারণে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিরীহ পথচারীদের। এসব ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ না নেয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভাঁটি মালিকসহ সংশ্লিষ্ট যানবাহন চালকরা। এসব ভাঁটিতে ইট তৈরির জন্য অবাধে বিশাল বিশাল এলাকা জড়ে পুকুর আকৃতির গর্ত করে উর্বর ফসলী জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। অনাবাদী ২ একর জমি ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও প্রতিটি ইটভাঁটি নির্মাণে ১০ একরের অধিক দো-ফসলি আবাদী কৃষি জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিধিমালা অনুযায়ী ভাঁটির ১ কিঃমিঃ এর মধ্যে আবাসিক বাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এলজিইডির পাকা রাস্তা থাকা চলবে না। ভবিষ্যতে কৃষি বিভাগ কর্তৃক ইটভাঁটির জন্য নির্ধারিত স্থানটি কৃষি জমি হিসেবে দাবী করলে এবং এ অফিস কর্তৃক ইটভাঁটি বন্ধ করার নির্দেশ প্রদান করা হলে উদ্যোক্তা ইটভাঁটি বন্ধ করতে বাধ্য থাকবে এবং কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা, স্থানীয় কৃষি অফিস দাবি তো দূরের কথা তাদের চোখের সামনে একের পর এক গড়ে ওঠা প্রতিটি ভাঁটি নির্মাণে ৩০ একরেরও বেশি কৃষি জমি ব্যবহার করছে ভাঁটি মালিকরা। ইটভাঁটির জন্য যে স্থান হতে মাটি কাটা হবে ওই স্থানকে পাড় বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ পুকুরে পরিণত করতে হবে যাতে সেখানে মৎস্য চাষ করা যায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে মজা পুকুর, খাল, খাড়ি, দিঘী, নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, চরাঞ্চল বা তৎসমতূল্য জায়গা থেকে ইট তৈরির মাটি সংগ্রহ করার কথা থাকলেও তা যেন শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। এ ভাঁটিগুলো এসব নিয়মের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখালেও কর্তৃপক্ষ অজানা কারণে নিশ্চুপ। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পাকা সড়কসহ গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা ব্যবহারে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কাঁচা রাস্তায় ভাঁটির কাজে নিয়োজিত যানবাহনগুলোর যাতায়াতের ফলে সাধারণ পথচারীসহ স্কুল-কলেজগামী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। সকালে স্কুলব্যাগ নিয়ে পরিষ্কার কাপড় চোপড় পরে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বিকেলে যখন বাড়ি ফেরে তখন দেখা যায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরের আদ্যপান্ত ধূলায় জড়ানো। এতে এসব শিশুরা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত গ্রামীণ কাঁচা-পাকা এ রাস্তাগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যা পুনঃনির্মাণে সরকারের অপচয় করতে হবে প্রচুর অর্থ। এ দিকে যেনতেনভাবে ট্রাক কিনে কাগজপত্র ছাড়াই সরকারী সম্পদ ধ্বংস করে উপজেলার মধ্যে অবাধে ভাঁটির ইট, বালি, মাটি বহন করে লাখ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করছে ট্রাক মালিকগণ। ফলে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারী সম্পদ যেমন- রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে উপজেলার ৪ লক্ষাধিক মানুষ। এ দিকে সম্প্রতি নির্মাণাধীন একাধিক ইটভাঁটির একটি তৈরি করা হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স, রায়গঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, রায়গঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন নিচু দোফসলী জমিতে। এ ব্যাপারে ভাটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান- পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমোদনসাপেক্ষে নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। ইটভাঁটিসহ এসব ট্রাকের বিরুদ্ধে সঠিক আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বৃদ্ধিসহ সরকারী সম্পদ রক্ষা হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও প্রশাসনের নীরবতায় বিবেকবান মানুষের মনে জন্ম নিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জনমনে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। রায়গঞ্জ ইটভাঁটি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু হানিফ খান বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র অনুমোদনহীন ভাঁটি করা হচ্ছে। কেউ কোন নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করছেন না। এটি প্রশাসনের দেখার বিষয়। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল আখতার খান বলেন, গত বছর বেশ কয়েকটি মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছিল। সেই সময় ওই ইটভাঁটিগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া ছিল। কিন্তু চলতি নতুন বছরে ওই ইটভাঁটিগুলো পরিবেশ অধিদফতরের সনদ এনে পুনরায় চালু করছে। এতে আমি কি করব। তিনি আরও বলেন, গতবারের বন্ধ ইটভাঁটিগুলো চালু হওয়ার কারণে ইটভাঁটির সংখ্যা বাড়ছে মনে হলেও আসলে বাড়ছে না।
×