ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

২০১৮ ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

২০১৮ ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ভারতে ২০১৮ সালের রাজনীতিটা হবে ২০১৯ সালের নির্বাচন নিয়ে। এ বছর যে ৮টি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা সেগুলোর ফলাফল দ্বারা নির্ধারিত হবে বিজেপি তার ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারবে কি-না। এই ৮টি রাজ্যের নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে বিজেপি জোট রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বঞ্চিত থাকছে কিনা। নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকা ৮টি রাজ্যের মধ্যে বিজেপি যদি মেঘালয়, মিজোরাম ও কর্নাটকে জিতে এবং এনডিএর শাসনাধীন রাজ্যগুলো হাতে রাখতে পারে তাহলে তাদের শাসিত রাজ্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ২২ এবং কংগ্রেসশাসিত রাজ্য থাকবে দুটি- পাঞ্জাব আর ক্ষুদে পন্ডিচেরী। এমনটা সম্ভাবনার বাইরে নয় এবং তাই যদি হয় তাহলে মোদির ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ লক্ষ্যটি বিজেপির প্রথম কার্যকলাপের মধ্যেই অর্জিত হবে। সুতরাং ২০১৮ সালে কংগ্রেস আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে। দলটি ইতোমধ্যে বিহার ও উত্তর প্রদেশে রাজনৈতিক গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এখন দক্ষিণ ভারতের একমাত্র উল্লেখযোগ্য যে রাজ্যে কংগ্রেস শাসন রয়েছে সেই কর্নাটকও যদি দলটির হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে জাতীয় বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের পরিচিতি দাবি অসার প্রমাণিত হবে। দলটিতে দেখতে লাগবে এতিম শিশুর মতো যা প্রাণশক্তির অভাবে শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সুতরাং কর্নাটককে হারানো কংগ্রেসের কিছুতেই চলবে না। কর্নাটককে হারানো সর্বনাশ হবে দলটির জন্য। এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিচারে কর্নাটকের লড়াই ২০১৮ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হবে। সেটা বলা মানে এই নয় যে ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান কংগ্রেসের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে কর্নাটক না থাকলে কংগ্রেসের দুর্গও থাকবে না, অস্ত্র ভা-ারও থাকবে না। কর্নাটক এর আগে বিজেপির দখলে ছিল। ২০১৩ সালে কংগ্রেস বিজেপির হাত থেকে তা ছিনিয়ে নেয়। কংগ্রেসের সেই জয়ের অন্যতম কারণ ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়োদি উরাপুরে বিজেপি জোট ত্যাগ করে কেজেপি নামে আলাদা দল গঠন এবং নির্বাচনে বিজেপির ভোটে ভাগ বসানো। কেজিপি মাত্র ৬টি আসনে জয় পেলেও পপুলার ভোট পেয়েছিল ১০ শতাংশ যা বিজেপির পক্ষে যাবার কথা ছিল। ফলে বিজেপির আসন সংখ্যা কমে ৪০-এ নেমে আসে এবং কংগ্রেস জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। সেই ইয়োদি উরাপুরে আবার বিজেপিতে ফিরে গেছেন। এতে দলের সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়েছে সন্দেহ নেই। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কংগ্রেসের সক্ষমতা এক বছর আগের তুলনায় যথেষ্ট বেড়েছে। তারপরও কর্নাটকের নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেস পুরোপুরি আস্থাবান হতে পারছে না। তার কারণ মোদি চরিত্রটি বড়ই অনিশ্চিত। তার সম্পর্কে আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি যে কখন কি করেন এবং কোন চালটি দিয়ে বসেন আগে থেকে কিছুই বলার উপায় নেই। রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ ও ছত্রিশগড়ের রাজ্যবিধান সভার নির্বাচন এ বছরের শেষদিকে হবার জোর গুজব শোনা যাচ্ছে। প্রায় একই সময় জাতীয় নির্বাচনও হওয়ার কথা। যাই হোক, ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ১২টি রাজ্য যদি বিজেপির দখলে আসে তাহলে রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা হবে এবং দলটি তখন সংবিধান সংশোধন করার অবস্থানে থাকবে। অর্থনীতির এই মন্থরতা কী কাটবে বর্তমানে ভারতের অর্থনীতিতে একটা মন্থরতা চলছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০১০ সালের পর থেকে সবচেয়ে তেজীভাব যখন দেখা যাচ্ছে সে সময় ভারতের নীতিনির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্তের দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত পরিণতি দেখা দিয়েছে। নীতিগুলো হচ্ছে বড় বড় ব্যাংক নোট বাতিল, পণ্য ও সার্ভিস কর এবং ব্যাংকের মন্দ ঋণ পুনর্বিন্যাস। এতে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বিস্মিত হয়েছে। এগুলো প্রবৃদ্ধি মন্থরতার জন্য দায়ী বলে বলা হয়। কিন্তু লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো, ভারতের প্রবৃদ্ধি ২০১৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের সময় থেকে কমে আসছে। অর্থাৎ বড় নোট বাতিলের ৬ মাস আগে এবং পণ্য ও সেবা কর চালু করার এক বছর আগে থেকে। মন্দ ঋণ সমস্যা ২০১৬ সালে সংবাদ শিরোনাম কাড়ে। কিন্তু তার আগে থেকে ২০১৪ সাল থেকেই ব্যাংক ঋণদানে কড়াকড়ি শুরু করেছিল। তাহলে ২০১৬ সাল থেকে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে এসেছে কেন? ২০১৪-১৫ তে প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তুলেছিল তেলের মূল্য হ্রাস। বিশ্বে তেলের দাম ২০১৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তুঙ্গে পৌঁছার পর ২০১৪-১৫ সালে ৭০ শতাংশ কমে গিয়ে ২০১৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে তলানিতে চলে আসে। তেলের এই ব্যাপক দরপতন ভারতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৬ সালের প্রথম দিক থেকে তেলের মূল্য বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি আবার প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বড় নোট বাতিল, পণ্য ও সার্ভিস ট্যাক্স ও মন্দ ঋণ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ভারতের প্রবৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯১-৯২ সালে অর্থনীতির উদারিকীকরণ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতে কর্পোরেট বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালে তা তুঙ্গে পৌঁছে জিডিপির ৩৭ শতাংশ হয়েছিল। বর্তমানে সেটা কমে জিডিপির ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটাও প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ার অন্যতম কারণ। ওদিকে বেসরকারী আবাসন ও এসএমই খাতে বিনিয়োগও গড় ৫ বছরে জিডিপির ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশটির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ তাৎপূর্ণ বহন করে। ২০০৩-৮ সালে ভারতে প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে পৌঁছেছিল। সে সময় বছরে রফতানি করেছিল ১৮ শতাংশ। অথচ গত ৫ বছরে রফতানি বেড়েছে বার্ষিক মাত্র ৩ শতাংশ হারে। এটাও অর্থনীতির মন্থরতার কারণ। ভারতের মাথাপিছু আয় ১৮০০ ডলার। রফতানির ওপর নির্ভর না করে কোন দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম নয়। ভারতের ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে এটাও সত্য যে বিশ্ববাণিজ্য প্রাক-মন্দা প্রবৃদ্ধির হারের কাছাকাছি কোথাও ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনাও নেই। এমতাবস্থায় ভারতের প্রবৃদ্ধি খুব যে বাড়বে মনে করা যায় না। তবে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভাল না হলেও মন্দের ভাল। এ হারে আগামী ২৫ বছর প্রবৃদ্ধি হতে থাকলে ভারতের মাথাপিছু আয় উন্নত দলগুলোর প্রায় ১৫ শতাংশ এবং এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর অর্ধেকে দাঁড়াবে। চীন-ভারত যুদ্ধ সম্ভাবনা নেই ডোকলাম নিয়ে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে চীন ভারত যুদ্ধ বাঁধে বাঁধে এমন এক অবস্থা হয়েছিল। এ বছরও কি তেমন পরিস্থিতি হবে বা যুদ্ধ বেঁধে যাবে? বিশ্লেষকদের মতে যুদ্ধ বাঁধার সম্ভাবনা নেই। তবে বিরোধ চলবে। বিরোধের উৎপত্তি ভুটান, চীন, ভারত এই তিনটি দেশ যে জায়গায় মিলিত হয়েছে সেই ত্রি-সংযোগস্থলে চীনের একটি সড়ক নির্মাণ নিয়ে। চীন কখনও ব্যাখ্যা করেনি এই সড়ক তার প্রয়োজন কেন। তবে ওটা যে একটা রাজনৈতিক চাল যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুটান ও ভারতের মধ্যে ফাটল ধরানো তাতে সন্দেহ নেই। স্পর্শকাতর ওই সড়ক নির্মাণ এমন এক সময় শুরু হয় যখন চীন ভুটানকে কাছে টানার চেষ্টা চালাতে থাকে। বলাবাহুল্য, একমাত্র এই প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গেই চীনের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। হিমালয় অঞ্চলে বর্তমান শক্তির ভারসাম্যে ভারতেরই প্রাধান্য। চীন ভুটানকে কাছে টানতে পারলে সেই ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ভুটানের সঙ্গে ভারত ১৯৪৯ ও ২০০৭ এই দুটি চুক্তির দ্বারা আবদ্ধ। ১৯৪৯ সালের চুক্তিতে ভুটানকে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হলেও এর পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত। ২০০৭ সালের চুক্তিতে ভুটানকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অধিকতর স্বাধীনতা দেয়া হয়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে চীন। ভুটানে ভারতীয় প্রভাব খর্ব করতে চাইছে। তার জন্য নিয়োগ করেছে তার গতানুগতিক নরম কূটনীতি। চীনের সার্কাস পার্টি ফুটবল দল ভুটানে গেছে। ভুটানী ছাত্র-ছাত্রীদের চীনে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ভুটানে চীনা ট্যুরিস্টের সংখ্যা বেড়েছে। দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও অসংখ্য সীমান্ত আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বঞ্চিত হচ্ছে। সীমান্ত উত্তেজনার এক পর্যায়ে ভারত হস্তক্ষেপ করে। ভুটানীরা ব্যাপারটা খুব একটা সুনজরে নেয়নি। তাদের এই অসন্তুষ্টিকে দ্রুত কাজে লাগায় চীন। ২ আগস্ট এক বিবৃতিতে চীন বলে যে ভুটানের সঙ্গে তার সীমান্ত ইস্যু একান্ত এই দুটি দেশের ইস্যু। এর সঙ্গে ভারতের কোন সম্পর্ক নেই এবং ভুটানের পথ থেকে ভূখন্ড গত দাবি জানানোর অধিকারও তার নেই। বিবৃতিতে আরও বলা হয় ভারত শুধু যে চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে তাই নয়, ভুটানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই ইস্যুটিকে এমনিভাবে তুলে ধরে চীন সমস্যার স্থায়ী সমাধান চায় না বরং একটা স্ট্যাটেজিক স্থিতিশীলতা চায় সেটাকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এটা এমন এক কৌশল যেটা বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার সময় কিংবা অন্যান্য সমস্যা দেখা দিলে কাজে লাগানো যেতে পারে। সীমান্ত নিয়ে একটু আধটু উত্তেজনা বজায় থাকা চীনেরই স্বার্থের সহায়ক। তবে চীন ও ভারতের মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য রয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ১৯৬২ সালের মতো আরেকটা যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। অনিষ্পন্ন সীমান্ত ইস্যুকে পুঁজি করে চীন ভুটানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাবে। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×