ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে গণকবর

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাখাইনে গণকবর

শাক দিয়ে হয়ত মাছ ঢাকা যেতেও পারে, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ খুন করে পার পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার ঘটনাকে বরাবরই অস্বীকার করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাখাইনে পাঁচটি গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় নতুন করে আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে দেশটি। এটাই নিয়তি এবং পরিণতি। পাপ করে শেষ পর্যন্ত রেহাই মেলে না। রাখাইনে এই গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে এখন তোলপাড় শুরু হয়েছে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। যদিও আমেরিকার পূর্ব ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। গত বছর ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকার পরিচালিত গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্য, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল তৈরি করে। এর ভিত্তিতে ইতালির রোমভিত্তিক সংস্থা পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই রায় ঘোষণা করে বলেছিল, মিয়ানমার সরকারের ওপর জরুরী ভিত্তিতে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। ওই রায় ঘোষণার ফলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপেও পড়েছিল। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যা ঘটেছে তা গণহত্যা বৈ অন্য কিছু নয়। এই নৃশংসতা-বর্বরতা হিটলারের নাৎসি-গেস্টাপো বাহিনী, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী আর একাত্তরে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন থেকে বাঁচতে যখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই প্রাণভয়ে ছুটেছে, তখন যুবকদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এত কিছুর পর তাদের সামনে দেশত্যাগ ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না। তারা নাফ নদী পেরিয়ে, পাহাড় বেয়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে; আগত অনেকে অমানবিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের স্বাক্ষর বহন করছে। একাত্তরে বাংলাদেশে হামলার হোতা ছিল পাক সামরিক জান্তা। এর আগেও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হয়েছিল। তখন ক্ষমতা ছিল সামরিক জান্তার হাতে। সে দেশে ক্ষমতার হাত বদলেছে। ক্ষমতা এখন নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত আউং সান সুচির মুঠিতলে; তিনি এখন সে দেশের সরকারের অংশ। এক সময় সারা দুনিয়ার শ্রদ্ধা আর ভালবাসা ছিল সুচির প্রতি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ডেসমন্ড টুটু তাকে বোনের মতো স্নেহ করতেন। ভালবেসে নিজের টেবিলে সুচির একটি ছবিও রেখেছিলেন। তিনি রোহিঙ্গা নিধনে বেদনাহত হয়ে সুচির উদ্দেশে পত্রে লিখেছেন- ‘তোমার নীরবতার দাম অনেক বেশি।’ তিনি নীরবতা ভেঙে সুচিকে ন্যায়, মানবতা ও দেশের ঐক্যের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অবশ্য মিয়ানমার সরকার বরাবরই রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ ও নিপীড়ন চালানোর কথা অস্বীকার করে আসছে। তবে সর্বশেষ এপির প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৪ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে নতুন গণকবর সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এপি। নিপীড়নের অভিযোগকারীর কেউ কেউ নিজেদের দাবির পক্ষে সময় চিহ্নিত ভিডিও সরবরাহ করেছেন। যা হোক, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুধু নিন্দা জানিয়ে দায় শোধ করা যাবে না। বিশ্ববিবেকের দাবি অনুযায়ী হন্তারকদের উচিত জবাব দিতে হবে।
×