ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিটেন্স

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিটেন্স

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে রেমিটেন্স এসেছে ১৩৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে রেমিটেন্স এসেছিল ১০০ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধনে রেমিটেন্স আয় বেড়েছে ৩৭ কোটি ৩ লাখ ডলার; যা প্রায় ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, প্রবাসী আয় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে জনগণও বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এরই প্রভাব পড়েছে সার্বিক রেমিটেন্সে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান বলেন, রেমিটেন্স আয় পাঠাতে বেশকিছু ডিজিটাল অবৈধ পথ তৈরি হয়েছিল। এসব জায়গায় আমরা কাজ করেছি। আমাদের মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করেছি। রেমিটেন্স আসার কয়েকটি অবৈধ চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়াও রেমিটেন্স বাড়ার অন্যতম কারণ। টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে প্রবাসীরা বেশি করে রেমিটেন্স পাঠাতে উদ্যোগী হচ্ছেন। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারিতে ১৩৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রেমিটেন্স এসেছে ৮৩১ কোটি ২১ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭১৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। সাত মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। মূলত গত দুই বছরের পড়তিভাব কাটিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, গত চার মাস ধরে টানা বাড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। রেমিটেন্স বৃদ্ধির এই ধারাকে ইতিবাচক অভিহিত করে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং অবৈধ পথে প্রবাসীদের অর্থ লেনদেনকারী মোবাইল এ্যাকাউন্টধারীদের বিরুদ্ধে অভিযানের কারণে প্রবাসীরা বৈধপথে (ব্যাংকিং চ্যানেল) টাকা পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশে জনশক্তি রফতানিও বেড়েছে। রেমিটেন্স প্রবাহের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। চলতি অর্থবছরে রেমিটেন্স ১৪ বিলিয়ন (এক হাজার ৪০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আনতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোরালো কার্যক্রম অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দিয়েছেন গবর্নর। রেমিটেন্স বাড়ার পিছনে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি। সে কারণে ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই রেমিটেন্স আনতে অতি বেশি উৎসাহী হয়েছে। বেশি টাকা পাওয়ায় প্রবাসীরাও বৈধপথে টাকা পাঠাচ্ছেন। কার্ব মার্কেট এবং ব্যাংকে ডলারের দাম এখন সমান। সে কারণেই কোন ঝুঁকি নেই ভেবে হুন্ডির মাধ্যমে না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। তাছাড়া দেশে উন্নয়ন কর্মকা- বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার (পণ্য আমদানির ঋণপত্র) পরিমাণ বেড়েছে। তাতে ব্যাংকগুলোর বেশি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। সে কারণে ব্যাংকগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আনতে আগ্রহী হয়েছে। বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক বাংকগুলোর কাছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। আর ব্যাংকগুলো সেই ডলার ৮৪ টাকার বেশিতে বিক্রি করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক বৃহস্পতিবার ডলার বিক্রি করেছে ৮৪ টাকা ১০ পয়সায়। সোনালী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৮৪ টাকায়। কার্ব মার্কেটেও (খোলা বাজারে) এই দরে ডলার বিক্রি হয়েছে বলে মতিঝিলের ডলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন জানিয়েছেন। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ডলার অবমূল্যায়িত ছিল। ভারত, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছিল। তার সুফল তারা পেয়েছে। আমরা অনেক দেরিতে সেই কাজটি করেছি। আমরাও তার সুফল পাচ্ছি। হুন্ডি কমছে। রেমিটেন্স বাড়ছে। জানা গেছে, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রায় পুরো সময় ধরেই নিম্নমুখী ছিল রেমিটেন্স প্রবাহ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) কিছুটা উর্ধগতি থাকলেও সেপ্টেম্বরে পুনরায় কমে যায় প্রবাসী আয়। অক্টোবর থেকে প্রবাসী আয় আবার বাড়তে থাকে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি রেমিটেন্সের নিম্নমুখী প্রবণতায় সরকারের সর্বমহলে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। রেমিটেন্স বাড়াতে মাশুল না নেয়াসহ নানা ঘোষণাও দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রবাসীদের জন্য বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। সর্বশেষ হুন্ডি রোধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স বিতরণের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের দুই হাজার ৮৮৭ জন এজেন্টের এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে প্রবাসীরা ৮৩১ কোটি ২১ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে জুলাইয়ে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ, আগস্টে ১৪১ কোটি ৮৫ লাখ, সেপ্টেম্বরে ৮৫ কোটি ৬৮ লাখ, অক্টোবরে ১১৬ কোটি ২৭ লাখ, নবেম্বরে ১২১ কোটি ৪৭ লাখ, ডিসেম্বরে ১১৬ কোটি ৩৮ লাখ এবং সর্বশেষ জানুয়ারিতে ১৩৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জানুয়ারিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স এসেছে ৩৩ কোটি ১৪ লাখ ডলার, বিশেষায়িত দুই কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে মাত্র এক কোটি ১৩ লাখ ডলার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১০২ কোটি ৪১ লাখ ডলার এবং বিদেশী ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে এক কোটি ২৭ লাখ ডলার। প্রসঙ্গত, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স আসে। এরপর প্রতিবছরই রেমিটেন্স কমে যেতে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমে গিয়ে রেমিটেন্স আসে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) তা সাড়ে ১৪ শতাংশ কমে আসে এক হাজার ২৭৭ কোটি ডলার, যা ছিল আগের ছয় অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো এই বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে।
×