ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আশ্রয় শিবিরে বাড়ছে সহিংসতা

রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার হাকিম এখনও অধরা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার হাকিম এখনও অধরা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র ডাকাত সর্দার রোহিঙ্গা নেতা আবদুল হাকিম। যার বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। রয়েছে খুন-অপহরণসহ ডজনখানেক মামলা। তার কাছে ভারি অস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ওই দস্যু সর্দারের নেতৃত্বে গহিন পাহাড়ে রোহিঙ্গা যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আবদুল হাকিমকে ধরতে ইতোপূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে। কয়েক সহযোগীকে অস্ত্রসহ আটক করে কারাগারে পাঠালেও দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম এখনও অধরা রয়ে গেছে। প্রশাসনের গাফিলতি না থাকা সত্ত্বেও বহুল আলোচিত ভয়ঙ্কর এ রোহিঙ্গা জঙ্গী কেন ধরা পড়ছে না তার ক্লু বের হয়নি এ পর্যন্ত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলছেন, হাকিম ডাকাতকে শেল্টারদাতা রয়েছে টেকনাফে। যার বদৌলতে অধরা থেকে গেছে কুখ্যাত এই ডাকাত সর্দার। ওই রোহিঙ্গা ডাকাতের আস্তানা থেকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় পালিয়ে এসেছে স্থানীয় যুবক নুরুল আবছার। এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে টেকনাফসহ পুরো সীমান্ত এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আবদুল হাকিম কয়েক বছর ধরে টেকনাফের গহিন পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অপহরণ, খুন, মুক্তিপণ, ইয়াবার চালান লুট ও চাঁদাবাজি করে চলছে। বাইরে রয়েছে তার একাধিক দালাল চক্র। জানা গেছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে হাকিম ডাকাতের গোপন আঁতাত রয়েছে। প্রত্যাবাসনে রাজি না হওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের হুমকিতে রাখতে হাকিম ডাকাতকে অঢেল টাকায় বশে নিয়েছে একটি গ্রুপ। হাকিম ডাকাতের সহযোগীরা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সম্মত না হওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। টাকার লোভে টেকনাফের ধনাঢ্য ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করছে। টেকনাফ পৌর এলাকার নাইট্যংপাড়ার মোঃ কাসেমের পুত্র নুরুল আবছারকেও ধরে নিয়ে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ভাগ্যিস বৃহস্পতিবার ওই ডাকাত দলের পাহাড়ী আস্তানা থেকে অপহৃত যুবক আবছার পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে এলাকাবাসী তাকে টেকনাফ থানায় নিয়ে যায়। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মঈন উদ্দিন খাঁন জানান, ডাকাতের কবল থেকে কৌশলে পালিয়ে আসা এক যুবককে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে তার গলায় লাগানো তালা ভেঙ্গে শেকল খুলে দেয়া হয়েছে। হাকিম ডাকাতের ব্যাপারে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ওই ডাকাতদলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ডাকাত সর্দার আবদুল হাকিমের সঙ্গে পুরনো রোহিঙ্গা নেতা আরএসও ক্যাডারদের বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই দিয়ে বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ এনে আত্মসাত করতে আরএসও ক্যাডাররা আবদুল হাকিমের মাধ্যমে আশ্রিত ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১২টি অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন বিরোধী দল ভারি করছে সন্ত্রাসীরা। সশস্ত্র সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের কারণে ক্যাম্পের পরিবেশ দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। বাড়ছে সহিংসতা। মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিরোধের জের ধরে এখানে পালিয়ে এসে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠেছে অনেকে। এছাড়াও প্রত্যাবাসনের পক্ষে স্থানীয় প্রশাসনের হয়ে কাজ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছে নিরীহ রোহিঙ্গারা। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ। তাই প্রত্যাবাসনে বিলম্ব হলে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এখনই জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। তারা বলেন, সকল রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে এখান থেকে সরিয়ে সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যেতে হবে রোহিঙ্গাদের। ঠেঙ্গারচর-ভাসানচরে নিয়ে গেলে উস্কানিদাতা পুরনো রোহিঙ্গা মৌলবিরা (আরএসও) সেখানে যেতে পারবে না। সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রোহিঙ্গাদের মুঠোফোনগুলো জব্দ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এদিকে ডাকাতের আস্তানা থেকে পালিয়ে আসা যুবক স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাতে রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে ৪ অস্ত্রধারী নাইট্যংপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে তাকে অস্ত্র ঠেকিয়ে চোখ বেঁধে অপহরণ করে গহিন পাহাড়ী আস্তানায় নিয়ে যায়। এসময় বাড়ির লোকজনের কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। নয় তো আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে হুমকি প্রদান করে। ডাকাতরা তাকে পাহাড়ে নিয়ে মারধর এবং একটি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। প্রচ- শীতে সারা রাত ওই অবস্থায় থাকি। দেখা গেছে, ভারি অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা ডাকাতরা প্রহরায় রয়েছে। ডাকাত সর্দার আবদুল হাকিম কাছে অস্ত্র রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বললে ডাকাতরা তাকে শেকলে বাঁধা অবস্থায় জঙ্গলের একপাশে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ডাকাতদের ফাঁকি দিয়ে তালাবদ্ধ শিকলসহ কৌশলে বাড়িতে পালিয়ে আসি। তিনি আরও বলেন, বছরখানেক আগেও আমার বড়ভাই তোফায়েলকে হাকিম ডাকাত অপহরণ করেছিল। এখনও মেলেনি তার হদিস। জানা গেছে, ওই ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আবদুল হাকিমের অপরাধের শেষ নেই। দীর্ঘদিন ধরে সে টেকনাফ উপজেলা কমপেক্স সংলগ্ন গহিন পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র ডাকাতদল (রোহিঙ্গা) গঠন করে খুন, গুম, লুট, ডাকাতি ও ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে আসছে। তার বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। বছরখানেক আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদর ইউনিয়নের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে হত্যাসহ একাধিক হত্যাকা- ঘটিয়েছে। ইতোপূর্বে বিজিবি, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাকিম ডাকাতের আস্তানায় একাধিকবার অভিযান চালিয়ে কয়েক সহযোগীকে অস্ত্রসহ আটক করে কারাগারে পাঠালেও দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম ধরা পড়েনি এ পর্যন্ত। অথচ তার বিরুদ্ধে টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বহুবার আলোচনা এবং আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
×