ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডা. এ.বি.এম. আবদুল্লাহ

ক্যান্সার ॥ ভয় নয় জয় করুন

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ক্যান্সার ॥ ভয় নয় জয় করুন

আজ ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার দিবস পালিত হচ্ছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘আমরাও পারি, আমিও পারি’। দিন দিন অসংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা বেড়েই চলছে। ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সার শব্দটি শুনলেই সবাই আঁতকে ওঠেন। একসময় মনে করা হতো, ক্যান্সারের কোন এন্সার (উত্তর) নেই। একবার ক্যান্সার হওয়া মানেই ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু এখন এই ধারণা একেবারেই অমূলক। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যান্সার মানে অবধারিত মৃত্যু নয়। ক্যান্সারের চিকিৎসাও আর অজেয় নয়। শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এ রোগের চিকিৎসা, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। নিত্যনতুন অধিক কার্যকরী কেমোথেরাপি জাতীয় ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে, রেডিওথেরাপিসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগে বেশ কিছু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করছে। উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর কারণসমূহের মধ্যে ক্যান্সার দ্বিতীয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৃতীয়। এক হিসেবে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২% মৃত্যুর জন্য ক্যান্সারই দায়ী। তাই ক্যান্সার হবার আগেই একে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। একটু সচেতন হলেই ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যান্সার বলতে সাধারণভাবে জীবকোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বোঝায়। এই কোষগুলো স্বাভাবিক নয়। বরং পরিবর্তিত বিধায় দেহের সাধারণ নিয়মে এদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে খুব দ্রুত এসব কোষের পরিমাণ বাড়তে পারে। কখনও কখনও এগুলো টিউমার বা চাকার মতো তৈরি করে এবং এক পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই অস্বাভাবিক কোষগুলো সুস্থ স্বাভাবিক কোষগুলোকে ধ্বংস করে ও শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধার সৃষ্টি করে। এগুলো ধীরে ধীরে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোকে অকেজো করে দেয় এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ক্যান্সার যে কোন বয়সেই হতে পারে, কিছুকিছু ক্যান্সার অল্প বয়সেই হয়, তবে সাধারণত বয়স্কদের মধ্যেই ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশি। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির মধ্যেও ক্যান্সারের পুরোপুরি কারণ এখনও জানা নেই। কিছু কিছু পারিপার্শ্বিক, পেশা, এমনকি জীবনযাত্রার পদ্ধতি বা কুঅভ্যাস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ– * প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান। * দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস। * খাদ্যাভাস (যেমন খাদ্যে ফাইবারের অভাব, ভিটামিন বা এন্টি-অক্সিডেন্টের অভাব)। * প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল বা রংযুক্ত খাবার। * আর্সেনিকযুক্ত পানি পান। * পরিবেশ দূষণ এবং কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা। * বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ (যেমন সূর্যরশ্মি, অতি বেগুনী রশ্মি, এক্সরে, কসমিক রে ইত্যাদি)। * কর্মস্থল বা পেশাগত কারণে অনেকের ক্যান্সার হতে পারে। যেমনÑ রেডিয়েশন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ রোদে থেকে কাজ করা, জাহাজ ভাঙ্গার শ্রমিক, রং ও রাবার কারখানার কর্মী ইত্যাদি। * বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা ইনফেকশনের ফলে ক্যান্সার হতে পারে, যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এপস্টিন বার ভাইরাস, হ্যালিকোব্যাক্টার পাইলোরি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস, এইডস ভাইরাস ইত্যাদি। সিস্টোসোমা জাতীয় জীবাণু মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূত্রাশয় ক্যান্সারের কারণ হিসেবে বিবেচিত। * অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা। * কিছু কিছু ঔষধ বা চিকিৎসা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। * অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী, পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি। * ক্রোমোজম বা জিনের কারণেও ক্যান্সার হতে পারে। ক্যান্সারের লক্ষণ নির্ভর করে কোথায় কি ধরনের ক্যান্সার হয়েছে তার উপরে। অনেকক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই থাকে না। দেখা গেছে, ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার পরেই তা ধরা পড়ে। তারপরও কিছু কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত– * সুস্থ ছিলেন, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া। * অরুচি বা ক্ষুধামন্দা। * অতিরিক্ত দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, দাঁতের গোড়ায় বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, চামড়ার নিচে জমাট রক্ত ইত্যাদি। * শরীরে কোথাও চাকা বা গোটা দেখা দিলে, বিশেষ করে গলায়, বগলে, কুঁচকিতে, পেটে বা মহিলাদের স্তনে। * দীর্ঘদিন জ্বর থাকলে, বিশেষ করে যদি রাতের বেলা প্রচুর ঘাম দেয়। * অনেক দিনের কাশি যা সাধারণ চিকিৎসায় ভাল হচ্ছে না, বিশেষ করে বয়স্কদের বেলায় এবং কাশির সঙ্গে রক্ত আসলে। * গলার স্বর ভেঙ্গে গেলে বা কাশির সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হলে। * বয়স্কদের প্রস্রাব করতে সমস্যা হলে, ব্যথা হলে বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে। * পায়খানার অভ্যাস পরিবর্তন হলে বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে। * খাবার গিলতে অসুবিধা বা ব্যথা। * বদহজম, দীর্ঘদিনের পেটে ব্যথা বা রক্তবমি। * মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের পরিবর্তন হওয়া, যাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আবার রক্তক্ষরণ হওয়া। * মাথাব্যথা, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো, হঠাৎ বমি করা ইত্যাদি। * চামড়ায় নতুন করে রঙের পরিবর্তন, তিলের আকার বা গড়ন পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি। তবে মনে রাখতে হবে, এ সমস্ত লক্ষণ অন্য বিভিন্ন রোগের কারণেও হতে পারে। তাই এগুলো হলেই ক্যান্সার হয়েছে ভেবে কেউ যেন অযথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পড়েন। অনেক ক্যান্সারই সময়মতো চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ক্যান্সারের প্রকারভেদে, কতটুকু ছড়িয়ে গেছে, কি কি সমস্যা করছে, রোগীর বয়স কত আর শারীরিক অবস্থা কেমন, এসবের ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের নানা রকমের চিকিৎসা দেয়া হয়। এজন্য চিকিৎসার আগেই বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষা, নানা রকমের স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা হয়। আবার অনেক ক্যান্সার চিকিৎসায় ভাল হয় না, অথবা ছড়িয়ে গেলে চিকিৎসা করার আর উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম। ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের যা যা করতে হবে তা হলো, জীবন যাপনে পরিবর্তন এনে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ক্যান্সারের এক-তৃতীয়াংশ কারণ জীবন যাপনের সঙ্গে জড়িত, যা অনেকে ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রণ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে পারেন। নিচের কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত - * ধূমপানসহ তামাকের যে কোন ধরনের ব্যবহার পরিহার করা। * মদপান পরিহার করা। * শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণসহ অন্য যেকোনো নেশা পরিহার করা। * সঠিক খাদ্যাভ্যাস- সুষম খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ (ফাইবার) ও এন্টি-অক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার খাওয়া, বিশেষ করে তাজা মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া, চর্বি জাতীয় ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, প্রিজারভেটিভ বা কেমিক্যালযুক্ত খাবার বর্জন, ফাস্ট ফুড ও কোমল পানীয় বর্জন ইত্যাদি। * আর্সেনিকমুক্ত পানি পান। * শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলা, এজন্য নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম এবং সঙ্গে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা। * দীর্ঘসময় সরাসরি সূর্যের নিচে না থাকা, প্রয়োজনে ছাতা বা হ্যাট ব্যবহার করা। * যৌনাভ্যাসের ক্ষেত্রে সামাজিক নৈতিকতা মেনে চলা, বহু যৌনসঙ্গী বা পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনকর্ম এবং অস্বাভাবিক যৌনাচার পরিহার করা। * রক্তদান বা গ্রহণ অথবা যে কোন ইঞ্জেকশন গ্রহণের সময় এবং এন্ডোস্কপি, কলোনোস্কপি ইত্যাদি পরীক্ষার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। * বেশ কিছু জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা নিয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব, যেমন হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের টিকা ইত্যাদি। * যেসব জীবাণু ক্যান্সার তৈরি করতে পারে, তা শরীরে ধরা পড়া মাত্র চিকিৎসা করে ফেলা। * কর্মক্ষেত্রে ক্যান্সার তৈরিকারী রেডিয়েশন বা কেমিক্যালের সংস্পর্শ পরিহার করা। * সন্দেহজনক যে কোন উপসর্গ যেমন চাকা বা গোটা, ক্ষত, তিলের রং পরিবর্তন, দীর্ঘদিনের জ্বর ইত্যাদি দেখা দিলে অবহেলা না করা। * এছাড়া প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তিরই উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, যাতে শরীরে কোন ক্যান্সার দানা বাঁধতে শুরু করলে, তা প্রাথমিক অবস্থাতেই দমন করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে বয়স্কদের বৃহদান্ত্র বা কোলন, মহিলাদের জরায়ুমুখ ও স্তন, পুরুষদের প্রোস্টেট ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যান্সার মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়। একটু সচেতন হলেই ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি ক্যান্সার হয়েও যায় তবুও শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে তার ভাল চিকিৎসা করা যায়। এমনকি কিছুকিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। তাই ক্যান্সার নামক এই বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ডিন, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×