ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ পানির উৎসসমূহের সুরক্ষা জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ পানির উৎসসমূহের সুরক্ষা জরুরী

পানি সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত একটি বিশেষ নেয়ামত। আর সৃষ্টিকর্তা তাঁর নেয়ামতগুলো অপচয় করতে আমাদের নিষেধ করেছেন। আমাদের দেশ এবং বর্তমান পৃথিবীর গবেষকরা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান অভাব এবং দূষিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত। অথচ এসবের মূলে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে পানি ব্যবহারে আমাদেরই অপচয় এবং উদাসীনতা। অপ্রয়োজনে পানি নষ্ট করা যেমন পানির অপচয়, তেমনি প্রয়োজন পূরণের সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খরচ করাও পানির অপচয়। আধুনিক পৃথিবীতে পানির জন্য হাহাকার আমাদেরই কর্মফল। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পানির গুণাগুণ ও শস্যের উৎপাদন কমে আসছে। হয়ত আর কয়েক বছর পর মানুষ পানি সম্পদের ক্ষতির জন্য নিজেদের দায়ী করবে। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত বর্জ্য পদার্থগুলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা এবং জীব বৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। কীটনাশক পদার্থ, রাসায়নিক সার- নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদিতে গিয়ে মিশছে। এর ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। বিষুব থেকে মরু অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের জীবনে জলবায়ু ও আবহাওয়ার শক্তিশালী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। চরম বৈরি আবহাওয়ায় ভারি বর্ষণ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রচুর লোকের জীবনের হুমকির সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তি ও জীবিকা ধ্বংস করছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতীয়মান হয়, এর সঙ্গে মানব সভ্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক দেশ যা করে অন্যত্র জনগণের ওপর তা প্রভাব ফেলে এবং আমরা সবাই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এখন যা করি, তার অনেকাংশই নির্দিষ্ট করবে কী ধরনের পৃথিবী এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাব। জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসস্থল ও খামার ধ্বংস বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উভয় ক্ষেত্রেই মানবগোষ্ঠীর বাস্তুহারার কারণ হতে পারে। এ ধরনের বাস্তুচ্যুতি পর্যায়ক্রমে অস্থিরতা ও সংঘাতের শঙ্কা ঘনীভূত করতে পারে। সে কারণে, জলবায়ু পরিবর্তন শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর বাস্তবিক প্রভাব ফেলে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতোমধ্যে খাদ্য উৎপাদনের জন্য মিঠা পানি ও জমি হ্রাস পেয়েছে, জীববৈচিত্র্য ও জীবিকা তাৎক্ষণিক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। পৃথিবীর সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হ্রদ-হিমবাহ, মেরুতুষার ও ভুগর্ভস্থ পানি দিয়ে বারিম-ল গঠিত। পৃথিবীর মোট পানির শতকরা ৯৭ ভাগ সমুদ্র। শতকরা দুই ভাগ পানি আছে হিমবাহ ও মেরুতুষারে। মানুষের পানীয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের উপযোগী মাত্র এক ভাগ পানির উৎস নদ-নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবা, কুয়ো, নলকূপ, ঝরনা ও ভূ-গর্ভ। নদীমাতৃক বাংলাদেশ। মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা এর নদী, শাখা নদী, উপনদী, খাল-বিল, জলাশয় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে। দেশটির মিঠা পানির উৎসসমূহকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ সেই নদীগুলোর খুবই করুণ অবস্থা। বহু নদী মরে গেছে। অনেক নদী মরার পথে রয়েছে। প্রবাহ না থাকায় খাল-বিলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দখলে-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও যে ক্রমেই মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অনেক ভূ-প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ। নদীগুলোর দখল ও দূষণ ঠেকানো খুবই জরুরী। ঢাকা চট্টগ্রামের আশপাশের নদীগুলোর নাব্য এখনও ফেরানো যায়নি। বুড়িগঙ্গা কর্ণফুলী নদীতে এখনও প্রাণের সঞ্চার হয়নি। অথচ এই বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর, কর্ণফুলীকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম। আমাদের মনে রাখতে হবে, নদী মরে গেলে স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি বদলে যায়, কৃষিতে প্রভাব পড়ে, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, দেশ ক্রমে মরুকরনের দিকে এগিয়ে যায়। আমাদের দেশের পানির প্রাকৃতিক উৎস ও প্রাকৃতিক সম্পদগুলো টেকসইভাবে ব্যবস্থাপনা করা ও সুরক্ষিত রাখা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের এই দায়িত্ব কারও ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। এটা অপরিহার্য, আমাদের জন্য, আমাদের সন্তানদের প্রজন্মের জন্য। আমরা যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার জন্য। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী চার দশকের মধ্যে আমাদের দেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে হ্রাস পাবে। এর ফলে পানির সঙ্কট দেখা দেবেই। এমনিতেই এদেশে সেচ সিক্ত জমির পরিমাণ খুব কম। তদুপরি পানির সঙ্কটের ফলে তা আরও কমে যাবে এবং স্বাভাবিকভাবে এর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না খাদ্যশস্যের উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন কমে যাবে, অন্যদিকে বর্ষা ঋতুর সময়সীমাও কমবে। বর্ষা ছাড়া অন্য ঋতুতে বৃষ্টি প্রায় হবেই না। দীর্ঘদিন ধরে অল্প বৃষ্টিপাত না হয়ে, কম সময়ে বেশি বৃষ্টি হবে। ফলে বৃষ্টির পানি নদী-নালা-খাল বাহিত হয়ে সাগরে বয়ে যাবে। কমে যাবে মাটির নিচে পানির সঞ্চয়, নেমে যাবে পানির স্তর। অন্যদিকে ভূমিক্ষয় বাড়বে। গবেষকরা পরিবেশগত তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। যার ফলে হিমবাহ গলে যাবে। পরিবেশগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এভাবে চলতে থাকলে হিমবাহ তথা তুষারাঞ্চলের অবক্ষয় ঘটবে। ফলে বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণামে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করবে। সংকুচিত হবে মিঠা পানির উৎসসমূহ এর ফলে ধ্বংস হতে পারে মানব সভ্যতা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে পানি সংরক্ষণ করছে। কোথাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এনজিও এবং স্থানীয় সরকার। কোন কোন শহরেও পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে নতুন ভবন তৈরির শর্তে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন যে বহুতল তৈরি হচ্ছে তার প্রতিটিতে রেন ওয়াটার পাইপের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে, যার সাহায্যে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়। বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষিত জলাশয় সুপেয় পানির ভা-ার। শহরাঞ্চলে যেসব জলাশয় বা পুকুর আছে তাতে বর্জ্য ফেলে পরিবেশকে করে তোলা হয়েছে আরও বিষাক্ত। সব পাড়ের বাসিন্দাদের সব ধরনের নোংরা আবর্জনা ফেলার অন্যতম স্থান এসব জলাশয়। এগুলো হতে পারত মাছ চাষের ক্ষেত্র, নৌবিহারের উপযোগী জায়গা, ভাসমান রেস্তরাঁ ইত্যাদি। একইভাবে বিভিন্ন শহরের অনেক জলাভূমি মরে গেছে। মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বহুতল মার্কেট কমপ্লেক্স। কালের গর্ভে এসব জলাশয় হারিয়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, থাকবেও না। এসব জলাশয় এবং বিলের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশবাদীদেরও গাছ লাগানোর বাইরে জলাভূমি সংরক্ষণেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশের যে বিপন্নতা, তার সমার্থক হলো মানুষের বিপন্নতা। আমাদের এ বিপন্নতা কোন বিদেশী সাহায্য অথবা সরকারী বদান্যে রোধ করতে পারবে না। পানির প্রাকৃতিক উৎসসমূহের সুরক্ষা না দেয়া একটি সামাজিক সমস্যা, এ সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও শিকার দুই-ই মানুষ। আর মানুষই পারে এ সমস্যা সমাধান করতে। তাই মানব সভ্যতার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পানির উৎসসমূহের সংরক্ষন বিশেষ জরুরী। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×