ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি

শতভাগ রিয়েল প্রশ্নপত্র লাগবে?

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 শতভাগ রিয়েল প্রশ্নপত্র লাগবে?

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘১০০% রিয়েল প্রশ্নপত্র লাগবে? তারা সরাসরি ইনবক্সে যোগাযোগ কর। এবারও আমরা সকল বোর্ডের Cq+Mcq বোর্ডের মূল কপি দেব।’ ‘যে কেউ চাইলে গ্রুপগুলোর সদস্য হতে পারছেন, প্রশ্ন পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ না করলেও কোন সমস্যা হবে না’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি বিটিআরসির কড়া নজরদারি ও হুঁশিয়ারির মধ্যেই ঠিক এভাবেই রীতিমতো দাপটের সঙ্গে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে চলছে বিজ্ঞাপন। প্রশ্ন সঠিক না ভুয়া এ নিয়ে কম-বেশি বিতর্ক থাকলেও অপরাধীরা যে প্রকাশ্যে দেশজুড়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই কারো। আজ শনিবারের পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে গতকাল শুক্রবার থেকেই বাধাহীনভাবে চলছে প্রশ্নফাঁসের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। ঠিক এমন অবস্থার মধ্যেই আজ শনিবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। এর আগে প্রশ্নফাঁস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার কঠোর নজরদারির মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শুরু হয় এবারের পরীক্ষা। পরীক্ষার আগেই হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল, আসল কিংবা ভুয়া কোন ধরনের প্রশ্নই ফেসবুক অন্য কোন মাধ্যমে ছড়ালে কারো রক্ষা নেই। গুজব ছড়ালেও আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রথম দিনও পরীক্ষার আগে একাধিক সেট প্রশ্ন প্রকাশ্যে ছড়িয়ে বিভ্রান্তির জন্ম দেয় অসাধু চক্র। সরকারের কোন সংস্থাই এখন পর্যন্ত কারো নাগাল পায়নি। ঠিক একইভাবে আজকের বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা নিয়ে শুক্রবার থেকেই ফেসবুকে চলছে প্রশ্নফাঁসের বিজ্ঞাপন! ফেসবুকে কড়া নজরদারির কথা বিটিআরসি বললেও হুঁশিয়ারির মধ্যেই ফেসবুকে বিজ্ঞাপনও চলছে। ঘটনার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদের নাগাল পাওয়া যায়নি। কয়েকবার সেলফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার অবশ্য বলেছেন, তারা বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন। কোন তথ্য পেলে জানানোর জন্য তিনি গণমাধ্যমের সহযোগিতাও চান এ কর্মকর্তা। তবে যারা এতদিন ‘ফেসবুকে কড়া নজরদারি’ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন সেই বিটিআরসির কর্মকর্তারাই যেন দর্শক। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেই বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে তারা ফেসবুক বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু ফেসবুকে এখন যা হচ্ছে তা নিয়ে তেমন কোন অগ্রগতির তথ্য কেউ বলতে পারছেন না। এদিকে ফেসবুকে নজরদারির বিষয়ে বিটিআরসির কর্মকা-ে হতাশা প্রকাশ করেছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তাই। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক কর্মকর্তা ফেসবুকে প্রকাশে প্রশ্নফাঁসের বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলেন, আমিই হতাশ। এসব বিষয়ে কিছু করতে পারছে না প্রতিষ্ঠান। যারা মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে গিয়ে বড় বড় কথা বলেন তারাও এখন দর্শক হয়ে আছেন। এ কর্মকর্তাই প্রশ্ন করে বলেন, যদি কিছু নাই করতে পারেন তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বড় বড় কথা বলার কি দরকার? আজ সকাল ১০টায় শুরু হবে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা, আর বৃহস্পতিবার প্রথমপত্রের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বিকেল থেকেই ফেসবুক পেজ ও গ্রুপগুলোতে দেয়া হচ্ছে বাংলা দ্বিতীয় পত্রসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের নিশ্চয়তা। ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপ ও পেজে একাধিক আইডি থেকে বাংলা প্রথম পত্র প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ দিয়ে বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় পত্রের চার সেট প্রশ্নই তারা নিশ্চিতভাবে ফাঁস করবে। প্রশ্ন পেতে ইনবক্সে যোগাযোগ করতেও বলা হচ্ছে। কেউ কেউ খুবই অল্প টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন দেয়ার কথা বলছে, কেউ বলছে বিনামূল্যেই দেবে। নিশ্চিতভাবে প্রশ্ন ফাঁস করতে পারে তা প্রমাণ করার জন্য একটি গ্রুপে এমনও বলা হয়েছে, গ্রুপের পেজেই পরীক্ষার আগে উন্মুক্তভাবে উত্তরসহ প্রশ্ন দিয়ে দেয়া হবে, মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত হওয়ারই দরকার নেই। ‘SSC Question Out 100% Common All BD Rezult Change 2018+19+20All Board’ নামক গ্রুপে ‘Jisan Khan’ আইডি থেকে শুক্রবার সকালে পোস্ট করা হয় ‘#ATtenson PLZ# (জ)’ গ্রুপে ‘রাকিব হাসান’ নামের আইডি থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর একটা ৪৯ মিনিটে বাংলা প্রথমপত্র প্রশ্নের ছবিসহ পোস্ট দেয়া হয়, সবাইকে দেখার অনুরোধ রইল কত ঘণ্টা আগে দিছি। আশা করি সবাই প্রমাণ পাইছো # বলা হয়েছে, ‘১০০% রিয়েল প্রশ্নপএ লাগবে তারা সরাসরি ইনবক্সে যোগাযোগ করো। এবারও আমরা সকল বোর্ডের Cq+Mcq বোর্ডের মূল কপি দেব।’ SSC Question Out, PSC, JSC, SSC, HSC Real Question Out All Board 100% Common, PSC JSC SSC HSC Real Question Out All Board 100% Common Suggestion & Out Question, PSC, JSC, SSC, HSC, Degree out question bank.(R), ssc exam question out 2018 ইত্যাদি গ্রুপসহ অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপে প্রশ্নফাঁসের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। এদিকে কেবল প্রশ্ন সরবরাহই নয়, পরীক্ষার ফলাফল বদলে দেয়ার গ্যারান্টি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘সোহাগ ইসলাম’ নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইল। বিভিন্ন গ্রুপে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। অথচ এই নম্বরের মালিকরা রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল পরিদর্শনে এসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে প্রথম দিনের পরীক্ষার প্রশ্নের কোন মিল নেই বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ফেসবুকে ছড়ানো প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের মিল নেই। আমি মিলিয়ে দেখেছি। বিষয়টি মিথ্যা ও গুজব। তবে যে ব্যক্তি এই প্রশ্নপত্রটি পোস্ট করেছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি। তারা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে বিভিন্ন কৌশল নিয়েছি। সব কৌশল বলা ঠিক হবে না। যেগুলো বলা যায় সেগুলো আগেও বলেছি। রিপিট করার প্রয়োজন নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা আছে। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুকে শুধু মনিটরিং এবং রিপোর্ট করে এই গ্রুপগুলো বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। যা করা যায় তা হলো যেই নম্বরগুলো ব্যবহার করা হয় তা ট্র্যাক করা। এই নম্বরগুলো এক ধরনের আর্থিক লেনদেনে ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই এদের বের করা খুব সহজ। প্রশাসন চাইলেই তা করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটিআরসি এ বিষয়ে শতভাগ ব্যর্থ। প্রশ্ন সরবরাহকারী বিজ্ঞাপনদাতাদের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট রিপোর্ট করে বন্ধ করানো হলেও তা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। রিপোর্ট করে ফেসবুক গ্রুপ কিংবা প্রোফাইল বন্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু বন্ধ করে লাভ কী? তারা ফের অন্য নামে আরেকটি এ্যাকাউন্ট খুলে একই কাজ শুরু করে। এক্ষেত্রে যা করা যায় তা হলো মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করা। মোবাইলের বায়োমেট্রিক ডেটা করা হয়েছে অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য। সেটা কাজে লাগানো যেতে পারে। এসব বিজ্ঞাপনদাতা লেনদেনে মোবাইল একমাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এমনকি ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ এগুলো ব্যবহার করতেও প্রয়োজন হয় মোবাইল নম্বর। প্রশাসন চাইলেই এদের খুঁজে বের করতে পারে।
×