ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ সন্ধ্যায় শপথ সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্র্ট বিভাগেও শীঘ্রই বিচারপতি নিয়োগ

আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি ॥ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন প্রধান বিচারপতি

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন  জারি ॥ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন প্রধান বিচারপতি

বিকাশ দত্ত ॥ অবশেষে নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিযে দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ৫৩ দিন প্রধান বিচারপতি নিয়োগকে কেন্দ্র করে নানা মহলে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আজ শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের কাছে শপথ নেবেন। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ইতোমধ্যে আইনমন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এদিকে শীঘ্রই সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারপতি নিয়োগ করা হবে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক স্বাক্ষরিত প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছেন। এই নিয়োগ তার শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক শুক্রবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার মনে হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজকেই (শুক্রবার) কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নাম ঘোষণা করবেন।’ প্রজ্ঞাপনটি কি শুক্রবারই হচ্ছে- জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে ঘোষণা পাবেন।’ নতুন প্রধান বিচারপতি পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, সেই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কোন নাম প্রস্তাব করি নাই। আর এটা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার, এতে হাত দেয়ার সাহস আমার নেই।’ অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রপতি উনাকে বিচক্ষণ (বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) মনে করেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এখানে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা। এখন প্রজ্ঞাপন জারি হবে। শনিবার শপথ নেবেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমি খুব খুশি। স্বস্তিবোধ করছি। অপেক্ষার অবসান হলো। তিনি বলেন, এখন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। শনিবার নতুন প্রধান বিচারপতির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেব। এছাড়া রবিবার এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির কোর্টে নতুন প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানাব। প্রধান বিচারপতির নিয়োগ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। সুতরাং এটি রাষ্ট্রপতির বিচার বিবেচনার বিষয়। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনের বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। আমাদের দেশে এর আগেও এরকম হয়েছে। জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। তিনি বলেন, এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অবসরগ্রহণের কথা থাকলেও দুর্নীতি ও অর্থপাচারসহ ১১ অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিন মাস আগেই পদত্যাগ করেন। সিনহার পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা। উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে গত ৩ জুলাই রায় দেন পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। পুনর্বহাল করা হয় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান। রায়ে কড়া সমালোচনা করা হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’-এর সংস্কৃতির। এরপরই এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকার ও সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা ও আইনজীবীগণ। সুপ্রীমকোর্টের আওয়ামীপন্থী আইনজীবীগণ কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় দুর্নীতির অভিযোগে ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া চলে যান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এরপর তিনি চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুর আসেন এবং গত ৯ নবেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে কানাডা যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। গত ১০ নবেম্বর সে পদত্যাগপত্র বঙ্গভবনে এসে পৌঁছে। এরপর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের পরিচয় ॥ ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মোস্তফা আলী। বিএসসি ডিগ্রী নেয়ার পর এলএলবি ডিগ্রী নিয়ে ১৯৮১ সালে আইন পেশায় যুক্ত হন তিনি। ১৯৮৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে। দুই বছর পর ২০০৩ সালে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি গঠিত দুটি সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ঘটনা প্রবাহ ২১তম প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ, আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব প্রদান, সর্বশেষ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পর সকল বিতর্কের অবসান ঘটল। গত বছরের ১৪ অক্টোবর ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র অস্ট্রেলিয়া যাত্রার পরদিনই তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, অর্থপাচারসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনে সুপ্রীমকোর্ট। তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান। আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির কথাও বলা হয়েছে। সেই দিনই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে বলে মনে করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ১৩ অক্টোবর পদত্যাগী প্রধান বিচারপতির বিদায়ের যাত্রাকালে তার বাসভবনের সামনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার আগে দেয়া বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ। সভাপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একাংশ প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে। পরে সমিতির সহসভাপতি মোঃ অজি উল্লাহ পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সুপ্রীমকোর্টের বিবৃতিতে বলা হয়, এসব অভিযোগ প্রধান বিচারপতিকে জানিয়ে আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি তার কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। কিন্তু, তিনি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এ কারণে বাকি বিচারপতিরা তার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় এস কে সিনহা পদত্যাগ করবেন বলেও তাদের জানিয়েছিলেন। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রাখার স্বার্থে ইতোপূর্বে সুপ্রীমকোর্টের তরফ থেকে কোন প্রকার বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে বিবৃতি প্রদান করা হলো। শীঘ্রই আপীল ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ ॥ খুব শীঘ্রই সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। সেই সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগেও কিছু বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। সদ্য নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতিসহ আপীল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মোঃ আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা চলতি বছরের ১১ নবেম্বর অবসরে যাবেন। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাবেন। আপীল বিভাগ ছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছেন ৮২ জন। যদিও আপীল বিভাগে এর আগে সর্বোচ্চ ১১ জন বিচারপতি বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এছাড়া বর্তমানে ৩ জন বিচারপতি কাজ করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বিচারক সঙ্কট রয়েছে নিম্ন আদালতেও। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার ১০ জনকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ২ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। তাদের মধ্যে গত ডিসেম্বরে একজন মারা যান। আর একজনকে বাদ দিয়ে বাকি ৮ জনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয় সরকার। বর্তমানে স্থায়ী নিয়োগ না পাওয়া দুই বিচারপতির রিট আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আপীল বিভাগে। ২০১৫ সালের পর গত আড়াই বছরেও উচ্চ আদালতে আর কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। সব মিলিয়ে এ বছর প্রধান বিচারপতি এমনকি আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগেও নতুন বছরেই বিচারপতি নিয়োগ হবে বলে জানা গেছে।
×