ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পৌর দাবি আমলে নিন ॥ আলম শাইন

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পৌর দাবি আমলে নিন ॥ আলম শাইন

যখন কোন মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং তিনি সেটি বুঝতে পারেন, ঠিক তখনই সেই মানুষটি তার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি এটি আমরা বেশি বেশি লক্ষ্য করছি। বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবীগণ তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সোচ্চার হয়ে মানববন্ধন, কর্মবিরতি কিংবা অনশনে যাচ্ছেন। এখানে যেমনি রয়েছেন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকগণ তেমনি রয়েছেন বাংলাদেশ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী। উল্লেখ্য, এই শ্রেণীর পেশাজীবীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ২০১৮ সালকে বেছে নিয়েছেন। কারণ, এই বছরের গুরুত্ব অন্য বছরের তুলনায় আলাদা। কাজেই সবার ধারণা, আন্দোলনে নামলেই বোধহয় কিছু একটা মিলে যাবে এ বছরে। তাই যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক বাছবিচার না করেই আন্দোলনে নেমে পড়ছেন এ পেশাজীবীরা । বিষয়টি ভাবনায় নিয়ে বলতে হয়, এখানে যত ধরনের পেশাজীবীর দাবি-দাওয়া রয়েছে এদের মধ্যে হুট করে দাবি মাথায় এনে মাঠে নেমেছেন দুই শ্রেণীর পেশাজীবী। টিন-কাঠ দিয়ে কোন রকম একটা ঘর বানিয়ে নিজেদের নিয়োগ নিজেরাই দিয়ে এখন অনশনে নেমেছেন দাবি আদায় করতে তারা। অথচ সে কাজটি করতে পারেন শুধুমাত্র বাংলাদেশ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেননা দেশের সংবিধানেও উল্লেখ রয়েছেÑ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের প্রশাসনিক ইউনিটে কাজ করবে এবং সরকারী কর্মচারী হিসেবে পরিচিতি পাবেন। সে মতে পৌরসভাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনও রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ-বদলিও মন্ত্রণালয় কর্তৃক হয়ে থাকে। ফলে তাদের জাতীয়করণের দাবিটি উড়িয়ে দেয়ার মতো মনে হয়নি। তাছাড়া তাদের দাবি-দাওয়াগুলো দীর্ঘদিনের। প্রায় দুই যুগ ধরে তারা এ ধরনের দাবি সরকারের কাছে রেখে আসছেন। যাতে করে বলা যায়, তাদের দাবি সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য নয়। মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি নিয়ে নেমেছেন তারা। সূত্রমতে জানা যায়, দেশে মোট পৌরসভার সংখ্যা ৩২৭টি। এতে ৩০ হাজারের অধিক কর্মজীবী রয়েছে। তাদের বাৎসরিক বেতন-ভাতাদির প্রয়োজন সাত শ’ কোটি টাকার মতো। যা সরকারী কোষাগার থেকে পরিশোধ করার দাবি জানিয়ে আসছে তারা। তাদের দীর্ঘদিনের সেই দাবিটি যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক তার খতিয়ান নি¤েœ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমরা জানি, যে কোন পৌর কর্মচারীই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জনসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যত ধরনের আইনী সহায়ক সনদপত্রের প্রয়োজন তার সব কিছুই পৌরসভা প্রদান করে থাকে। এ ছাড়াও রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রিটেনিং ওয়াল থেকে শুরু করে সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্ম সম্পাদন করতে হয় পৌরসভাসমূহকে। পৌরসভার মাধ্যমেই সরকার উন্নয়নের মানচিত্র অঙ্কন করে থাকেন দেশের মফস্বল শহরগুলোতে। শুধু তাই-ই নয়, জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্বভারও পৌরসভার ওপর বর্তায়। যেমন সড়কবাতি, পয়ঃনিষ্কাশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিনোদনকেন্দ্র, স্কুল-কলেজ স্থাপন এবং সুপেয় জলের যোগান দেয়াসহ বহুবিধ কর্মকান্ড পৌরসভার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সনদপত্রও পৌরসভাকে প্রদান করতে হয়। বিনিময়ে যদিও পৌরসভা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি গ্রহণ করে থাকে, তবে সেটি কোনমতেই সহনীয় ক্ষমতার বাইরে নয়। বলা যায়, যৎসামান্য ফি গ্রহণ করে সেবা দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, এসব কর্ম সম্পাদন করতে হয় পৌরসভার কর্মচারীদেরই। তাদের শ্রম, মেধা বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন এবং পরিকল্পিত নগর জনগণকে উপহার দিতে সক্ষম হয় পৌরসভা। অথচ সেই উন্নয়নের কারিগরদের জীবনযাত্রা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। যাদের কল্যাণে আমরা বিভিন্ন সুবিধাদি পেয়ে থাকি তাদের জীবনযাত্রা কতটুকু পরিচ্ছন্ন কিংবা তাদের সেই অন্ধকার দিকটি কি আমরা কখনও জানতে চেষ্টা করেছি? হতবাক করা বিষয়টি হচ্ছে পৌর কর্মচারীরা চাকরি চলাকালীন মুহূর্তেও নিয়মিত বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন না এবং অবসরে গেলে পাচ্ছেন না পেনশন-গ্র্যাচুইটি। বলা যায়, এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের দিনাতিপাত ঘটছে। শুধু তাই-ই নয়, নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারা ভীষণভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যার সামান্যতম উদহারণটি হচ্ছেÑ দেশের অধিকাংশ পৌরসভার কর্মচারীরা এক-দুই মাস নয়, এক-দুই বছর যাবত বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন না! অবিশ্বাস্য এ কঠিন সত্যটির প্রমাণ পেয়েছি আমরা বহুবার। গত ২৭/১২/২০১৭ তারিখে রাজধানীতে দেশের ৩২৭টি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমাবেশ করেছেন। স্থানীয়ভাবে বেতন-ভাতা দেয়াতে অনেক সময় কর্মচারীরা সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা না পাওয়ার কারণে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী এ্যাসোসিয়েশন এ মহাসমাবেশের আয়োজন করেছে। তাদের এক দফা এক দাবি- সরকারী কোষাগার থেকে বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা। বিষয়টি এতদিন অন্ধকারে ছিল, এই সত্য তথ্যটি ওইদিন বেরিয়ে আসে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী এ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের বক্তব্যের মাধ্যমে। নেতারা আরও জানিয়েছেন- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত পৌরসভার সমসাময়িক প্রতিষ্ঠান ওয়াসা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এবং এলজিইডি সরকারী কোষাগার থেকে বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকলেও সে রকম সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতোপূর্বেও দেশের পৌরসভার কর্মচারীরা একই ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের সেই ন্যায্য দাবির প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পৌর সভাসমূহের পেনশন প্রথার উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগটি সরকারের শেষদিকে নেয়াতে তার সমাপ্তি টেনে যেতে পারেনি। ফলে পৌর কর্মচারীদের ভাগ্যে নেমে আসে অনাকাঙ্খিত জীবন। সেই জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পেতে পৌর কর্মচারীরা ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ দিনের কর্মবিরতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। দাবি আদায়ের জন্য ভাংচুর প্রথাকে পরিহার করে সুন্দর দৃষ্টিনন্দন সমাবেশের মাধ্যমকে বেছে নেন। এবং পরবর্তীতে আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সবই আমরা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছি। দেখতে পেয়েছি ক্ষুধার্ত সেই মানুষগুলোর মুখচ্ছবিও। যা এতদিন অনেকেরই অজানা ছিল। লোকলজ্জা কিংবা সামাজিকতার ভয়ে যে মানুষগুলো এতদিন মুখ খোলেননি তারা এখন বাধ্য হয়েছেন তাদের কষ্টের কথা দেশবাসীকে জানাতে। প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পাপার্থী, সেটি প্রকাশ্যেই জানিয়েছেনও তারা। তাদের দাবির প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মেয়রগণও। তারাও দাবি রেখেছেন পৌর কর্মচারীদের জাতীয়করণ করার। সেই দাবিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখা জরুরী বলে মনে করি। তিনি যেন পৌর কর্মচারীদের লুকানো ব্যথায় ব্যথিত হয়ে তাদের সহজতর জীবনযাত্রার সুব্যবস্থা করে দেন। যাতে করে এরা আরও পরিচ্ছন্ন-পরিকল্পিত একটি ডিজিটাল শহর জনগণকে উপহার দিতে পারেন। সেই প্রত্যাশা রইল সকলের। লেখক : কথাসাহিত্যিক [email protected]
×