ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

নদী সুরক্ষায় চাই গণজাগরণ

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নদী সুরক্ষায় চাই গণজাগরণ

নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্ম নদীর পানিতে বয়ে আনা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিকণা দিয়ে। লাখো বছরের প্রক্রিয়ায় পলি সঞ্চয় করে নদীই গড়ে তুলেছে ‘ব’ আকৃতির পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের প্রধান নদীগুলো তার যৌবন হারাচ্ছে, শাখা নদী, উপনদীগুলো মরে বিলীন হয়েছে। অথচ বাঙালীর জীবনধারণ, ইতিহাস-ঐহিত্য, সংস্কৃতি সবই নদী মিশ্রিত, নদী আশ্রিত। নদীর ভাঙ্গাগড়ার ভেতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে বাঙালীর জীবনধারা, পেয়েছে নিজস্বতা। নদীর জলে অবগাহন-পরিশুদ্ধি, নদীর জলে চাষাবাদ, মিঠা পানির মাছ, নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ যুগে যুগে বাংলাকে করেছে সমৃদ্ধতর। নদী নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছে, আমরা শুধুই নিয়েছি। নদী বিলীন হয়েছে, কিন্তু আমাদের অভাব পূরণ হয়নি। ফলে সরকারী পরিসংখ্যানেই নদ-নদীর সংখ্যা ৭০০ থেকে ৪০৫-এ নেমেছে। বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা আরও কম ২৩০। নদীর উজানে অন্য দেশের বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- আর দখল রাজত্ব নদীকে অঙ্গহানি করে তিলে তিলে মারছে। নদীর সঙ্গে মরছে নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। তাতে বিপদ আরও বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে, সস্তায় পণ্য পরিবহনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। নদীর মাছ হয়ে উঠছে অমূল্য পণ্য। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার করা জেলে-মাঝিদের জীবনধারা বাস্তব থেকে চিত্রশিল্প হয়ে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। কেবল ভূ-খ- সৃষ্টি আর দেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলাই করেনি নদী; বাংলার শুধু নয়, বিশ্বের প্রায় সব সভ্যতার বিকাশও ঘটিয়েছে নদী। খ্রীস্টপূর্ব ৪৫০ বছরের পুরনো সভ্যতার খোঁজ মিলেছে নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে, পুরনো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। মহাস্থানগড় থেকে পাহাড়পুর, ময়নামতি, কোটালীপাড়া, সোনারগাঁ, খলিফাতাবাদ, বারোবাজার জনপদ গড়ে উঠতেও ভূমিকা রেখেছে নদী। মুক্তিযুদ্ধেও মায়ের রূপে অবির্ভূত হয়েছে নদী। ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’ সেøাগান বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে স্বাধীনতার খরস্রোত জাগিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উত্তাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চও এই সেøাগানে প্রকম্পিত করেছে তরুণ প্রজন্মকে। এ দেশে আছে খরস্রোতা নদী, আছে শান্ত নদী। বিশাল উত্তাল পদ্মা, মেঘনা, যমুনাও রয়েছে। নদীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় মানুষের জীবনও। উনিশ শতকে ভৈরব, কপোতাক্ষ, যমুনা মজে যেতে থাকলে যশোরে লোকসংখ্যা কমতে থাকে। সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে ১৮৮১ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে যশোরে লোকসংখ্যা কমে যায় ৫০ হাজার। মরা নদীতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ে। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ১৯৬৮ সালে মরা নদী ও নদী-তীরবর্তী মানুষকে নিয়ে লেখেন ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস। ওই সময়ই চিত্রা নদী তাজা হয়, জনবসতি বাড়তে থাকে নড়াইল ও মাগুরায়। প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া যে নদীর এত দান সেই নদীর প্রাণ কেড়ে নিতে চলছে যেন প্রতিযোগিতা। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল সাত শ’রও বেশি, এখন তা ৪০৫টিতে নেমেছে। বেসরকারী সংস্থাগুলোর তথ্যে নদীর সংখ্যা আরও কমে ২৩০টিতে নেমেছে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র নদীসংখ্যায় বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০ থেকে ২৭০টির উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ সাড়ে চার দশকে প্রায় পাঁচ শ’ নদী মরে গেছে, নদীপথের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উভয়ই কমেছে। নদীর সঙ্গে কমছে নৌপথও। স্বাধীনতাকালে নৌপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, এখন নেমেছে ছয় হাজার কিলোমিটারে। শীতকালে নৌপথ আরও কমে নামে তিন হাজার ৮২৪ কিলোমিটারে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো, ট্রলার, ফেরি নৌকা এবং বার্জের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন মালামাল পরিবহন হয়। নৌপথে পরিবহন ব্যয় সড়কপথের চেয়ে অন্তত ২০ গুণ কম হয়। নদীর নাব্য না থাকায় শীতকালে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ছে, যা দেশে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে, শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। আবার এই নদীগুলোই কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য বড় আশীর্বাদ। নদীগুলোর মাধ্যমে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আসা নদীগুলো বয়ে আনে প্রায় এক হাজার ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার। বাকি ৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাত থেকে আসে। অথচ বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ এই বিপুল জলরাশির দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। ফলে নদীর পানির বড় অংশই বঙ্গোপসাগরে চলে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এত পানি পেয়েও কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। তবে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নদী খননের মাধ্যমে কিছু পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়। প্রকল্প গ্রহণ করে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উন্নয়ন ও দেশ রক্ষায় নদ-নদী বাঁচানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি আবারও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজে ব্যবহারের বাস্তব কোন উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। এক সময়ের নদীবিধৌত বাংলাদেশে বড় বন্যায় নদী ফুলে পানি লোকালয়ে এলেও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকত না। বন্যার পানি নেমেও যেত তাড়াতাড়ি। ফলে ক্ষেতের ফসলও খুব বেশি নষ্ট হতো না। বরং পলির আশীর্বাদে শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠত দেশ। কিন্তু ভারত পদ্মা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার পর বন্যার চরিত্র পাল্টে যায়। দেশে আগ্রাসী বন্যা হয় ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ২০০৪ ও ২০১৭ সালে। প্রাণহানি কিংবা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে এসব বন্যা পুরনো সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। প্রলয়ঙ্করী এসব বন্যার মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মানুষ সৃষ্ট কারণকেই দায় দিচ্ছেন। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে শাখা, উপ-নদী বন্ধ করে দেয়া, নাব্য হ্রাস, উজানে বাঁধ, অনেক নদী মরে যাওয়া, খাল-বিল ভরাটের কারণেই মূলত প্রলয়ঙ্করী বন্যা হচ্ছে। ফারাক্কা নির্মাণের চার দশকের মধ্যে পদ্মাসহ দেশের বড় নদীগুলোর প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পদ্মা নদীর বড় অংশে চর পড়েছে। কৃষি কাজে সেচেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। আর তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবায় বাঁধ দেয়ায় তিস্তায়ও মিলছে না পানি। ফলে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে পড়ছে সমুদ্রের লোনা পানি। ভারত, নেপাল ও ভুটান ৫৫২টি বাঁধের মাধ্যমে দুই লাখ ১২ হাজার ২৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে হিমালয় থেকে নেমে আসা বিভিন্ন নদীর ওপর ৪২৯টি বাঁধ দিয়ে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করবে ভারত। এসব প্রকল্পের বেশ কিছুর নির্মাণ কাজ চলছে, বাকিগুলো প্রস্তাবিত। চীন ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থলে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিব্বতের অংশে ইয়ারলাং স্যাংপো নামের এই নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন ছাড়াও মঙ্গোলিয়ার ভেতরের দিকে পানি নিয়ে যাবে চীন। এতে চীন থেকে ভারত অংশে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি কমবে, আরও কমে যাবে বাংলাদেশ অংশে। বাঁধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা ভারতীয় বিশেষজ্ঞ শ্রীপাদ ধর্মাধিকারী ‘মাউন্টেইন অব কংক্রিট : ড্যাম বিল্ডিং ইন দ্য হিমালয়াস’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, ‘এ ধরনের বাঁধ নির্মিত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।’ কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ওই দেশগুলোর সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। আসলে বাংলাদেশের যে পানির প্রয়োজন আছে সেটি ভারত ভুলতে বসেছে। ভারতের পানির চাহিদা যতই বাড়ুক তাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের নদী মরে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ নদীকেন্দ্রিক অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন। পদ্মা ও যমুনার সংযোগকারী বড়াল নদের মুখে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সøুইস গেট, ক্রস ড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল বড়ালের পানি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন ও পানিপ্রবাহ বাড়ানো হবে, নৌপথ সম্প্রসারণ হবে। প্রথম তিন বছর প্রকল্পের সুফল মিললেও এরপর থেকেই শুরু হয় বিপর্যয়। পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ কম থাকার সময় বড়ালের মুখে সøুইস গেট বসানোয় পদ্মা থেকে বড়ালে পানিপ্রবাহ আরও কমে যায়। ফলে বহু স্থানে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। অন্যদিকে যমুনার যে অংশে বড়াল নদী মিশেছে সেখানে পানিপ্রবাহ নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ ভাঙ্গন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় যমুনাও। বড়াল শুকিয়ে শুকনা মাঠে পরিণত হয়। সেই মাঠ এখন নদীখেকোদের দখলে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে নড়াইলের লোহাগড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে এর পূর্ব-উত্তরাংশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তখন থেকে ধুঁকতে ধুঁকতে এখন নদীটি মৃতপ্রায়। আর যে অংশে বাঁধ দিয়ে সøুইস গেট বসানো হয়েছিল তা এখন শুকনা খাল। সেচ কাজে এ নদীর পানি ব্যবহার করা ও বন্যানিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে দেয়া বাঁধ কেড়ে নিয়েছে নদীটির প্রাণ। অবৈধ দখলদাররাও গ্রাস করে ফেলছে নদীগুলো। ঢাকার তুরাগ নদের মিরপুর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার প্রবাহ থাকলেও এটি অতিশয় শীর্ণ। এ অংশে নদীর বড় অংশই দখলবাজদের দখলে। বেড়ি বাঁধের চটবাড়ী এলাকায় নেবারল্যান্ড নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে পার্ক। এই পার্কের ভেতর নদীর পিলারও রয়েছে। নদীর বুকে অনেক স্থাপনা গড়ে উঠলেও নির্বিকার প্রশাসন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যানুযায়ী তুরাগে ১৫২টি সীমানা পিলারের মধ্যে ৯০টিই অবৈধ দখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। নদী দখলের এই চিত্র সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের নদীর প্রাণহীন হওয়ার জীবনচিত্রকেই তুলে ধরে। মুক্ত পানির সঙ্গে সখ্য থাকা মাছও হারিয়ে যাচ্ছে নদীর সঙ্গে। এক সময় দেশের মাছের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান দিত দেশের নদ-নদী, হাওড়, বাঁওড় ও বিলগুলো। প্রতিবছর যেমন নদী কমছে, কমছে মিঠা পানির মাছের পরিমাণও। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে দেশের নদীগুলোতে এক সময় ২৯০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন এ সংখ্যা ১০০-এর নিচে। মূলত জলাশয় সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে নদ-নদীতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে, কমে যাচ্ছে বিচরণ ক্ষেত্র। এ কারণে মাছের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। নদী রক্ষায় করণীয় যেসব কারণে নদী মরে যাচ্ছে এবং দখল হচ্ছে তা প্রতিরোধ করতে হবে শক্তভাবে। যত্রতত্র উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিয়ে নদীবান্ধব প্রকল্প নিতে হবে। নদীর দূষণ ঠেকাতে হবে। উজানে যেসব নদীর ওপর ভারতসহ অন্য দেশ বাঁধ দিয়েছে ও দিচ্ছে আলোচনা করে সেসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। নদী শাসনের বদলে নদীর সঙ্গে সহাবস্থান করার পদক্ষেপ নিতে হবে। যত্রতত্র বাঁধ, পোল্ডার, সøুইস গেট দিয়ে নদী শাসনের নামে নদী হত্যা বন্ধ করতে হবে। নদীর দখলবাজি শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। নদী রক্ষায় ‘নদী নীতি’ করা যেতে পারে। এই দেশে বহু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নীতি থাকলেও নদী নিয়ে নীতি নেই। শুধু নীতি করলেই চলবে না, সেই নীতি বাস্তবায়নে সংসদে আইন পাস করতে হবে। সরকার শক্ত হলে নদী রক্ষা পাবে। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী দখল করে থাকেন সাধারণত সরকারী দলের স্থানীয় নেতারা। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আমাদের দেশে আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন। কিন্তু তা দিয়েও নদী রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, নদী রক্ষায় কমিশনের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। আইনটিও অত্যন্ত দুর্বল। নদীর দখল, দূষণ ও অবকাঠামো নির্মাণ হলে তা ঠেকাতে শুধু সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে নদী রক্ষা কমিশন। দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। দ্রুত আইন সংশোধন করে নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি ওই আইন বাস্তবায়নে নদী আদালত গঠন করতে হবে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সবখানেই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে, অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধের সব ব্যবস্থা নিতে হবে পরিবেশ অধিদফতরকে। আর জলাভূমির লিজ বন্ধ করতে হবে ভূমি মন্ত্রণালয়কে। সেইসঙ্গে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে মৎস্য অধিদফতরকে। আর আন্তঃদেশীয় নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। যারা নদী দখল ও দূষণ করছে তারা প্রভাবশালী। ওই প্রভাব ভেঙ্গে দিয়ে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে নদী দখল বন্ধ হবে। তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। নদী রক্ষায় সরকারকে সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নদী ভরাটের অন্যতম কারণ উজান থেকে নেমে আসা পলি। তাই নদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্য রক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রতিবছর সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। গঙ্গা ব্যারাজ করতে পারলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পানি বর্ষায় জমিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সেই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে শুল্ক মৌসুমে নদীর নাব্য কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, নদীগুলো মরে যাওয়ায় শুধু অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব পড়ছে না, একই সঙ্গে জনজীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভিঘাত নেমে আসছে। নদীহীন জনপদে নদীর জন্য শুধু হাহাকারই নয়, বহুমাত্রিক সঙ্কটও তৈরি হচ্ছে। বাংলার নদ-নদীগুলোর অপমৃত্যু জীবনের ওপর শুধু ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে না, জাতীয় জীবনের সব অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেবে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা এবং দখল রোধের দায়িত্ব দেয়া আছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। আবার নদীর দূষণ ঠেকানোর দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের। এভাবে নদী রক্ষার সঙ্গে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনও। তবুও রক্ষা পাচ্ছে না নদী। তাই নদী সুরক্ষায় গণজাগরণ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। পরিবেশ ও অর্থনীতি উভয়ক্ষেত্রেই নদীর যে গুরুত্ব সে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিজ বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদী সম্পর্কে শিক্ষার ব্যবস্থার পাশাপাশি দখলদার এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। লেখক : সাংবাদিক
×