ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

‘নির্বাচনের বছর ॥ কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে’

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

‘নির্বাচনের বছর ॥ কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে’

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভাবেন কি আর বাংলাদেশ ব্যাংক, মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক করে কি? আগে তার ভাবার কথাটা বলি। অর্থমন্ত্রী ২৮ জানুয়ারি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের কারণে এ বছর বাজারে কালো টাকা ছড়াছড়ির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, এ বছর নির্বাচনের বছর, টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি হবে, কালো টাকা হয়ত বাজারে যথেষ্ট আসবে। তাই ঋণ বিতরণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ এই অনুগত সাধারণ মাত্রার চেয়ে উঁচুতে আছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এটা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার তাদের বিশেষভাবে জোর দিতে হবে, কারণ আপনারা সবাই জানেন এ বছর নির্বাচনের বছর। দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্টটি থেকে আমি একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েই নিবন্ধটি শুরু করলাম। অর্থমন্ত্রী এই মত দেন রবিবার। সোমবারের কাগজে তা ছাপা হয়। ঘটনাক্রমে ওইদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর তাদের ‘মানিটারি পলিসি স্টেটম্যান্ট’ ঘোষণা করেন। তা ছাপা হয় ৩০ জানুয়ারি মঙ্গলবার। তার মানে দুই-একদিনের তফাত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী যা ভাবছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাবছে ঠিক উল্টোভাবে। ধরা যাক ঋণের কথাই। অর্থমন্ত্রী বলেছেন ঋণ বিতরণে সাবধান হতে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ বিতরণে সম্প্রসারণমূলক পথ ধরেছে। সেই ঋণ বৃদ্ধি জানুয়ারি-জুন সময়ে ঘটবে ১৫ দশমিক ৮ ভাগ বিগত ছয় মাসেও তা একই ছিল। অবশ্য এখানে একটা কিন্তু আছে, ঋণের দুটো ভাগ : সরকারী ঋণ এবং বেসরকারী ঋণ। সরকারী ঋণ বাড়বে না। কারণ, সরকার ঋণ নিচ্ছেই না বলা চলে, অর্থাৎ ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে না। অতএব ঋণ বাড়ানো হবে বেসরকারী খাতে। বেসরকারী খাতে বিগত ছয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের বিপরীতে আগামী ছয় মাসে ঋণ বাড়বে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। মজা হচ্ছে বিগত ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেসরকারীখাতে ঋণ বেড়েছে দুই শতাংশেরও বেশি। তার মানে কী দাঁড়াল? ঋণের সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পিত হারের চেয়ে অনেক বেশি। এখন আরও বাড়বে! তাহলে অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ রইল কোথায়? তিনি ঋণ ও আমানতের অনুপাত আমাদের দেশে বেশি বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও তাই দেখা যাচ্ছে। অনেক ব্যাংক ৮০ শতাংশ ঋণও আমানতের অনুপাত না মেনে ঋণ বিতরণ করছে অনেক বেশি। মুদ্রানীতিতে এর লাগাম টানার কোন কথাও নেই। বরং বলা হয়েছে জুন মাসের পরে দেখা হবে বিষয়টি। তার অর্থ কী? অর্থ দাঁড়াচ্ছে ঋণ বাড়বে, বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়বে। ‘ভদ্রভাবে’ ঋণ বাড়লে কারও মাথা ব্যথার কোন কারণ নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঋণ বাড়ার সঙ্গে কয়েকটি জিনিসের সংযোগ ঘটে যাচ্ছে। ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন জিনিসের আমদানি এমনভাবে বাড়ছে যা যে কোন হিসাবে বেশি। ‘মিডিয়ার’ রিপোর্টেই দেখছি সয়াবিন, পেঁয়াজ ও চিনি আমদানি অনেক বেশি হচ্ছে। যে পরিমাণে এসব ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ছে এই পরিমাণ পণ্যের চাহিদা দেশে নেই। অতএব কথা উঠেছে টাকা পাচারের। বরাবরের অভিযোগ। কিন্তু এখন অভিযোগ উঠেছে বেশি বেশি। বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি বেশি, রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ কম, কম রেমিটেন্সও। অতএব ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে, বলাইবাহুল্য এখানে সন্দেহ আছে পাচারের। যতটুকু না প্রয়োজনীয় আমদানি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি, আমদানি হচ্ছে পাচারের উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, পাচারের সঙ্গে সম্পর্ক কালো টাকার যার ইঙ্গিত অর্থমন্ত্রী দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, এটা নির্বাচনের বছর। অতএব কালো টাকার ছড়াছড়ি হবে। মুশকিল হচ্ছে এই ছড়াছড়ি বৃদ্ধিতে যদি ব্যাংক ঋণ কাজে লাগে তাহলে ভীষণ বিপদ। অথচ এই আশঙ্কাই তৈরি হচ্ছে ব্যাংকিংখাতে। বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ছে না। ব্যবসায়ীরা বার বার বলছেন, বিনিয়োগে নানা বাধার কথা। এমতাবস্থায় ঋণপত্র এত বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? ঋণপত্রের মাধ্যমে টাকা পাচার হয় এটা অতি প্রাচীন কথা। এই পাচারকৃত টাকা যারা চায় তারা আবার দেশে এনে নির্বাচনের কাজে লাগাতে পারে। ধরা যাক, প্রকল্প ঋণ ৭০ কোটি টাকার। চীনা মালের জন্য ঋণপত্র যোগ হলো ৩০ কোটি টাকার স্থলে ৭০ কোটি টাকা। একে ওভার ‘ইনভয়েসিং’ বলে। চীনা রফতানিকারকের কাছে চলে গেল ৭০ কোটি। ৪০ কোটি টাকা বেশতি টাকা যা আমদানিকারকের টাকা। এই টাকা কালো হলো। অর্থাৎ ঋণের টাকাই কালো হলো। ওই টাকা ব্যবসায়ী চীনা রফতানিকারকের কাছ থেকে দেশে নিয়ে এলো আমদানি-রফতানি ‘ম্যাকানিজমের’ মাধ্যমেই। পুরো টাকাটাই কালো হলো। ওই টাকা এবার দরকার নির্বাচনে। এই কথাটাই সম্ভবত বলেছেন অর্থমন্ত্রী। শুধু প্রকল্প ঋণের মাধ্যমে টাকা পাচার হয় না, টাকা কালো করা হয় না। ভোগ্যপণ্যের আমদানির মাধ্যমেও তা করা হয়। মজা হচ্ছে কড়াকড়ির আইন ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ থাকা সত্ত্বেও কিন্তু এই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় নির্বাচনকে আমলে রেখে বেসরকারী ঋণের লাগাম টেনে ধরা উচিত ছিল। অথচ দেখা যাচ্ছে বেসরকারী খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হয়েছে। আবার হবে কী, ছয় মাস পরে দেখা যাবে বেসরকারী খাতে ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে বলেছে মেয়াদী ঋণ না দিতে, অর্থাৎ মেয়াদী ঋণকে নিরুৎসাহিত করতে। অথচ ব্যাংকগুলো সমানে তা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ সব ব্যাংকই এখন আমানত নেয় মোটামুটি তিন মাসের জন্য। মেয়াদী আমানত বলতে তিন মাসের আমানত। আগে ব্যাংক তিন বছর, দুই বছর, এক বছরের জন্যও আমানত নিত। এখন ব্যাংকগুলো সাধারণভাবে তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য মেয়াদী আমানত নিতে চায় না। এর অর্থ তাদের আমানত স্বল্পস্থায়ী। অথচ ঋণ দেয়া হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদের। এমনকি ‘ট্রাস্ট রিসিটের’ (টিআর) বিপরীতে দেয়া স্বল্পকালীন ঋণও হরেদরে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদী ঋণে রূপান্তর করছে। বড় বড় ঋণ সব পুনর্গঠন করে দীর্ঘমেয়াদী করা হয়েছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ আমানত স্বল্পমেয়াদী এবং এর বিপরীতে ঋণ দীর্ঘমেয়াদী। একে ব্যাংকাররা বলে ‘ফান্ড মিসম্যাচ’। খুবই মারাত্মক ঘটনা। অথচ এটা চলছে হরেদরে। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কী? কাজ হলো ঋণ সম্প্রসারণকে সীমার মধ্যে রাখা। ব্যাংকগুলো যাতে ঋণ ও আমানতের অনুপাত মেনে চলে তা দেখা। অথচ আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে সময় দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। নিয়ম, বিধি-বিধান না আনলে তা মানানোর যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্ত করতে পারে। ব্যাংকের বোর্ড বাতিল করতে পারে। পরিচালক বা চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করতে পারে। এত ক্ষমতা আর কোন্ প্রতিষ্ঠানের আছে কীনা তা জানা নেই। এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ঋণ ও আমানতের অনুপাত ভেঙ্গে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সাহস দেখায়। ঋণ ও আমানতের সুদের তফাতকে বলা হয় ‘স্প্রেড’। এই স্প্রেড ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। অথচ প্রচুরসংখ্যক ব্যাংক এই বিধি অমান্য করে বেশি সুদ আদায় করছে, আমানতকারীদের কম সুদ দিয়ে ঠকাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বার বার বলছে ঋণ যাতে কিছু হাতে কেন্দ্রিভূত তা হয়। অথচ তা হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্যাংকের মালিকানায় শক্ত আইন আছে যাতে কিছু পরিবারের হাতে অর্থ প্রদানের ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত না হয়। এত বিধি-বিধান থাকার পরও কেন বিপরীত সব ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হচ্ছে? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। অথচ সবাই চায় শক্ত একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাইরের হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। এটা আমার মত নয়। জনমনে ধীরে ধীরে এই ধারণা প্রকট হচ্ছে। অবশ্য যেখানে অর্থমন্ত্রী যা চান, তা হয় না সেখানে বলার কী আছে। এই মুহূর্তের কাজ কালো টাকার দৌরাত্ম্য অন্তত নির্বাচনে ঠেকানো। এর অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংক ছাড়া সিংহভাগ ক্ষেত্রে কালো টাকা বানানো, কালো টাকা বিদেশে রাখা অথবা দেশে আনা বড় কঠিন ব্যাপারে। আসতে পারে ছোটখাটো পরিমাণের টাকা। কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনা ঘটবে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে যেখানে থাকে ব্যাংকারদের নীরব সম্মতি। অতএব নির্বাচনের পূর্বে ঋণ অনুমোদন, ঋণপত্র খোলা, পণ্যের দাম পরীক্ষা, ঋণ নবায়ন, পুনঃতফশিলকরণ এবং প্রকল্প ঋণ অনুমোদন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই দরকার মনিটরিং, কঠোর মনিটরিং। এই কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×