ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব জলাভূমি দিবস আজ

নিঃশেষ হচ্ছে জলাধার হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 নিঃশেষ হচ্ছে জলাধার হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

সমুদ্র হক ॥ ‘এ নদী এমন নদী জল চায় একটুখানি...’। দেশের নদ-নদীগুলোর অবস্থা এমনই। নিঃশেষ হয়ে পড়ছে জলাভূমি। বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর। ছোট নদীর অনেকগুলোই পরিণত হয়েছে মরাগাঙে। কোনটি পরিণত খাল ডোবা নালায়। চেনাই যায় না। কোন ছোট নদী ও বিল অস্তিত্ব হারিয়ে মানুষের মুখে মুখে শুধু নাম নিয়ে বেঁচে আছে। বলাবলি হয় একদা সেখানে নদী ছিল। প্রকৃতি ও পরিবেশের এমন অবস্থার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। জাতিসংঘের অধিবেশনে বিশ্বের প্রতিটি দেশের জলাভূমির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বলা হয় জলাভূমি নিছক মাছের আঁধার নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রকৃতিকে ব্যালান্স করে চলার প্রচুর জলজ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী। দেশে বর্তমানের জলাভূমির অবস্থা সুখকর নয়। একের পর এক চর জেগে উঠে আর বালিয়াড়ি হয়ে বড় নদীগুলোর ‘প্রমত্তা’ অধ্যায়টিকে মুছে যাওয়ার পথে। বিপন্ন হয়ে পড়া জলের আঁধারে আবাস হারাচ্ছে মাছ। ওরা খুঁজে পায়না বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র। অস্তিত্ব হারানোর পথে জলজ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী। সরাসরি হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। পানি বিজ্ঞানীদের কথা- জলাভূমি হলো আমাদের ভবিষ্যত। জলাভূমি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের মিঠা পানির সুস্বাদু মাছের অনেক প্রজাতি হারিয়ে গেছে। একজন পরিবেশবিদ জানান, গোটা বিশ্ব জলাভূমি সেচে যে নগরায়ণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে তাতে পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক থাকছে না। নানা ধরনের দুর্যোগ আঘাত করছে দেশে দেশে। তিনি মন্তব্য করেন- সাগর সেচে মানিক পাওয়া যায়, জলাভূমি সেচে পাওয়া যায় দুর্যোগ। বিশ্বের জলাভূমি যে বড় হুমকির মুখে এই বিষয়টি প্রথম দৃষ্টিতে আসে ১৯৭১ সালে। কাস্পিয়ান সাগর তীরে ইরানের বামাসার নগরীতে প্রাণিবিজ্ঞানীরা এক সম্মেলনে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করেন। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক উপযোগিতা তুলে ধরে প্রথম দিবসটি পালন করে। সেই থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ২ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালিত হচ্ছে । বাংলাদেশের সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওড়ের জলাভূমি আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে নদ-নদী খাল বিল হাওড়ের দেশ। পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের চার জেলার মধ্যে যে হাওড় তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে। যশোর মরা নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে বিজ্ঞানীদের ভাষায় অক্সবো লেকে পরিণত। যা মূলত বাঁওড়। সকল জলাভূমি রক্ষার বিষয়টি উঠে এসেছে বিশ্ব ফোরামে। একদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রকৃতির বিরূপতা এবং আরেকদিকে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগে জলাভূমি মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদ-নদীগুলোর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের অন্তত ৬২টি নদীর চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কের মধ্যে পার হওয়া ছোট নদীগুলো শুকনো ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে হচ্ছে চাষাবাদ। নদী নামের ওই শুকনো ভূমির ওপর নির্মিত কনস্ট্রাকশন ব্রিজের এক কোণায় ছোট করে এঁটে দেয়া নদীর নাম দেখে ধরে নেয়া হয় সেখানে একদা ওই নদী ছিল। বগুড়ার শিবগঞ্জের এমন একটি নদী নাগর। যা মরা গাঙে পরিণত। নাগর নদী নামটি সাধারণের মুখে মুখে ফেরে। প্রজন্মের কাছে নদী অপরিচিত। নদী নামের এই ভূমির ওপর মেলা ও হাট বসে। বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী দখল ও ভরাট করে (প্রকারান্তরে নদী হত্যা করে) তার ওপর নির্মিত হচ্ছে অবকাঠামো, দৃষ্টিনন্দন বহুতল শপিংমল। দেশজুড়ে এমন নদী অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে যার চিহ্ন পর্যন্ত রাখা হয়নি। দেশের সবচেয়ে বড় উত্তরাঞ্চলের চলনবিলের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। প্রশ্ন জাগে- এই কি সেই ইতিহাসখ্যাত চলনবিল! ব্রিটিশরা যা দেখে বলতো এটা বিল নয় নদী! বিশাল জলরাশির সেই বিল শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় উনিশ শতকের (১৮শ’ সাল) শুরুর দিকে চলনবিলের আয়তন ছিল ১ হাজার ৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯শ’ ৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩শ’৬৮ বর্গকিলোমিটার। একবিংশ শতকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটারে সামান্য জলাশয় নিয়ে টিকে আছে এই বিল। বিল পাড়ের বিলদহর, চামারী ইউনিয়ন ও আশেপাশে নগরায়ণের প্রভাবে পাকা সড়ক ও হাটবাজার বসেছে। যেখানে গিয়ে কল্পনাই করা যায় না এই নৌপথ ছিল দুর্গম বন্ধুর পথ। চলনিবলে একদা ভরবছর জেলেরা মাছের আধার গড়ে তুলেছিল। সেই জেলে সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই আজ বড় নগরীগুলোতে গিয়ে মজুর খাটছে। এদের একটা অংশ পেশা বদল করে মাছ ছেড়ে শুঁটকির কারবারি হয়েছে। চলনবিলের টিকে থাকা জলাভূমির কাছে গেলে দেখা যায় সেখানে গড়ে উঠেছে শুঁটকির চাতাল। জেলেরা মাছ ধরে এনে শুঁটকি করার পর চাতালে দেয়া হচ্ছে। সেদিনের অনেক জেলে আজকের শুঁটকি ব্যবসায়ী। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমির প্রায় ২ কোটি হেক্টর জলাভূমির অস্তিত্ব সরাসরি হুমকির মুখে। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীতে পদ্মা, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জে যমুনা, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র, লালমনিরহাটে তিস্তা, গোয়ালন্দে মেঘনা, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দাসহ উল্লেখ্যযোগ্য নদীর দিকে তাকালে জলাভূমির অস্তিত্ব হারানোর দৃশ্য খালি চোখেই দেখা যায়। এর বাইরে ধরলা খলসডোঙ্গা, আত্রাই, বড়াল, ইছামতি, তেঁতুলিয়া, নাগর, নারদ, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কঙ্কাবতি, কাকেশ্বরি, চিকনি, রূপনাই, বাঙালী, করতোয়া, মাথাভাঙ্গা, নদীশুখাসহ নাম না জানা অনেক নদী আজ শুকনো ভূমি। গত পাঁচ বছরে পদ্মা মেঘনা ও যমুনায় যে চর জেগে উঠেছে তার পরিমাণ অন্তত চার হাজার বর্গ কিলোমিটার। যা মোট ভূমির প্রায় দেড় শতাংশ। সবচেয়ে বেশি চর পড়ছে যমুনায়। একটা সময় পদ্মা প্রমত্তা অবস্থাটি ধরে রেখেছিল। হালে পদ্মায় পড়ছে বিশাল চর। অনেক ডুবোচর পড়েছে ব্রহ্মপুত্র পদ্মা মেঘনা যমুনায়। মরা গাঙ দেখে সুর ভেসে আসে এ নদী এমন নদী জল চায় একটুখানি...।
×