ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনোয়ার হোসেন

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

বৃহস্পতিবার ছিল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন। এদিন থেকে শুরু হলো বায়ান্নর ভাষাশহীদদের নিবেদিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রথম দিনেই তুমুলভাবে জমাট বাঁধেনি বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা। চোখে পড়েনি পাঠকের উপচেপড়া ভিড়। তাই বলে আবার ম্রিয়মাণ হয়নি চেতনার সাক্ষ্যবহ এই মেলা। শীতের বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই সংখ্যায় স্বল্প হলেও বইপ্রেমীদের আগমনে সরব হয়েছে গ্রন্থমেলা। আর সন্ধ্যায় পূর্ণিমা পক্ষের আলোয় পেয়েছে স্নিগ্ধ রূপ। প্রাণ ও মননের মেলার সঙ্গে আত্মসংযোগ ঘটিয়েছেন গ্রন্থানুরাগীরা। ঝকঝকে মলাটের সদ্য বেরুনো বইয়ের সন্ধানে ঘুরেছেন স্টলে স্টলে। খুঁজেছেন পছন্দের লেখকের গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাস। কোন পাঠক আবার গবেষণাধর্মী কিংবা প্রবন্ধের বইয়ের তালাশ করেছেন। এদের মধ্যে কেউ বা বই কিনেছেন। আবার অনেকেই শুধু নতুন বইয়ের খোঁজ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মাসব্যাপী চলমান বইয়ের মেলায় সুবিধামতো সময়ে যে কোন দিন এসে কিনে নেবেন নিজের আগ্রহের বইটি। বরাবরের মতো এবারও মেলার দুই ভেন্যু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মনের আনন্দে ঘুরে বেরিয়েছেন এসব পাঠক। বলা যায়, লেখক-প্রকাশক ও আয়োজক সবার মানসিক সংযোগ ঘটিয়ে যাত্রা শুরু করল মাসব্যাপী একুশের গ্রন্থমেলা। আজ শুক্রবার মেলার দ্বিতীয় দিন। এদিন মেলার দ্বার খুলবে বেলা ১১টায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রথম শুক্রবারেই শিশুপ্রহর ঘোষণা করেছে বাংলা একাডেমি। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহরে অভিভাবকদের নিয়ে মেলায় বই কিনতে পারবে শিশুরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রী মেলাস্থল ত্যাগ করার পর তুলে নেয়া হয় নিরাপত্তাবেষ্টনী। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে আসতে থাকেন গ্রন্থানুরাগীরা। তাদের মধ্যে কেউ বা বই কিনেছেন আবার কেউ বা শুধুই ছুঁয়ে দেখেছেন নতুন আসা বইটি। অনেকেই আবার সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন প্রকাশনীর নতুন বইয়ের ক্যাটালগ। মেলার দ্বিতীয় দিনই শুক্রবার হওয়ায় আজ থেকেই মানুষের সমাগম বাড়বেÑ এমনটাই প্রত্যাশা করছেন প্রকাশকরা। এদিকে মেলার প্রথম দিনেও চালু হয়নি কমপক্ষে অর্ধশতাধিক স্টল। এছাড়া সোহরাওয়াদী উদ্যান অংশে চোখে ধুলোর ওড়াউড়ি। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় এক পাঠকের সঙ্গে। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের শিক্ষিকা নুরুন্নাহার রুমা অনুভূতি প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে বলেন, এখনও মেলা পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত হয়নি। অনেক স্টলই চালু হয়নি। তবে প্রথম দিনে লোক কম হওয়ায় স্বচ্ছন্দে চালু হওয়া স্টলগুলো ভালোভাবে ঘুরে দেখতে পারছি। সেই সুযোগে মনের মতো বইটি বেছে নিতেও সুবিধা হচ্ছে। একটা নতুন বইও কিনে ফেলেছি। অনন্যা প্রকাশনীর সামনে দেখা মেলে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে প্রথম দিনেই মেলার প্রকৃত রূপটি বোঝা কঠিন। কারণ এখনও অনেক স্টলই গোছানো হয়নি। তারপরও প্রথম দিন মেলায় এসে মনে হচ্ছে এবারের মেলা বিগত বছরের তুলনায় আরও ভাল হবে। কারণ এবার মেলার পরিসর বেড়েছে। দিন যত যাচ্ছে মেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কথা হয় জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও অন্য প্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। বলেন, মেলার সুন্দর করার প্রথম শর্ত হচ্ছে ধুলোমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আয়োজক বাংলা একাডেমিকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে লোকবল বাড়িয়ে কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে এ বছরের মেলার স্টল বিন্যাস ভাল হয়েছে। গত বছরের তুলনায় আলোকব্যবস্থাও ভাল হয়েছে। প্রথম দিনে উদ্যান অংশের মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক স্টল চালু হয়নি। এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বেহুলা বাংলা, বর্ণ বিচিত্রা, গোল্ডেন বুকস্্, বনলতা, অনার্য, রামন পাবলিশার্স, প্রকৃতি, মনন প্রকাশ, প্রতিভা প্রকাশ, বিশ^কলান পাবলিশার্স, বাঁধন পাবলিশার্স, রাতুল গ্রন্থপ্রকাশ, উলুখড়, মধ্যমা, টুম্পা প্রকাশনী, সিঁড়ি প্রকাশন, রেয়ার বুকস, জ্যোতিপ্রকাশ, একুশে বাংলা প্রকাশন, ম্যাগনাম ওপাস, নক্ষত্র, জ্ঞানবিতান, বইবাজার, বাংলালিপি, সবুজপাতা, মেঘ, তিউরি প্রকাশন, আলীগড় লাইব্রেরি, আলোরভুবন, কামরুল বুক হাউস, তরফদার প্রকাশনী প্রভৃতি। এর মাঝে অনেক স্টলে মেলার প্রথম দিনেও চলেছে কাঠামো বিন্যাসসহ রঙের কাজ। এছাড়া মেলার একাডেমির অংশের বহেড়া তলায় লিটলম্যাগ চত্বরে প্রথম দিনেও পাওয়া গেছে পেরেক পেরেক ঠোকাঠুকির শব্দ। ১৩৬টি স্টলের মধ্যে চালু হয়নি একটি স্টলও। এর বাইরে মেলার দর্শনার্থীদের জন্য এখনও চালু হয়নি টয়লেট। এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, মেলার নীতিমালা অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারির মধ্যে মেলার স্টলসজ্জার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। আশা করি প্রথম দিন অচল থাকা স্টলগুলো শুক্রবারের মধ্যে স্টল চালু হবে। সেটা হলে না নীতিমালা মেনে আমরা স্টল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেব। লিটলম্যাগ চত্বরের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এবার এ চত্বরটি প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীতে লিটলম্যাগের স্বত্বাধিকারীদের দাবির মুখে সেটি বরাবরের মতো বহেড়াতলায়ই রাখা হয়। সেজন্য হয়ত এখনও স্টলগুলোর কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করছি তারাও শুক্রবারের মধ্যে স্টল বিন্যাস সম্পন্ন করবে। প্রথম দিনের নতুন বই ॥ বৃহস্পতিবার মেলার প্রথম দিনে তথ্যকেন্দ্র উন্মুক্ত না হওয়ায় একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রথম দিনে প্রকাশিত নতুন বইয়ের সঠিক সংখ্যান জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন স্টল ঘুরে বেশকিছু নতুন বইয়ের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে রয়েছে মধ্যে কথাপ্রকাশ থেকে যতীন সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের চড়াই উৎড়াই’ ইমতিয়ার শামীমের ‘কাল অকাল’, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে বেরুনো হাসান আজিজুল হকের ‘আমার ইলিয়াস’ ঐতিহ্য থেকে আসা নূরুল আনোয়ারের ‘মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকা- : দুর্যোধনটি কে?’, তাম্রলিপি থেকে বেরিয়েছে বুলবুল সারওয়ারের ‘মহাভারতের পথে : এক’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘সাইক্লোন’ গুলতেকিন খানের ‘চৌকাঠ’, আহসান হাবীবের ‘সত্যি অ্যাডভেঞ্চার’, অবস থেকে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের ‘সেরা সাত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’, কাকলী প্রকাশনী এনেছে সুমন্ত আসলামের ‘তুমি আছো তাই’, অনিন্দ্য এনেছে আহমদ রফিকের ‘কবিতার বিভিন্ন ভাষা’, দ্বিজেন শর্মার ‘নিসর্গকথা’, প্রথম থেকে বেরিয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘পিতার হুকুম’, মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর ‘বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল : অবরুদ্ধ ৬৮ বছর’, আগামী থেকে এসেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘সময় অসময়’ এবং অনন্যা থেকে বেরিয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘একটি রহস্য উপন্যাস’। আজকের আয়োজন ॥ আজ শুক্রবার মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে রাত নয়টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সজিব কুমার ঘোষ। আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে আলোচনা করবেন মহীবুল আজিজ, প্রফুল্লচন্দ্র সিংহ ও রাশেদ রউফ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। মেলার টুকিটাকি তথ্য ॥ এবারের মেলায় একই সঙ্গে বেড়েছে পরিসর ও সময়। দুই ক্যানভাস বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৫ লাখ বর্গফুট জুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে গ্রন্থমেলা। গত বছরের মেলার সময়সূচী সাড়ে আটটার পরিবর্তে এ বছর রাত নয়টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে মেলা। ২৪টি প্যাভিলিয়নে সজ্জিত হয়েছে বাংলা একাডেমির ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সব মিলিয়ে মোট ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১৯টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবার। একাডেমির বহেড়াতলায় ১৩৬টি লিটল ম্যাগাজিনকে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গতবারের মতো এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঠাঁই পেয়েছে শিশু কর্নার। গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমিসহ অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাশ মূল্যছাড়ে বই বিক্রি করবে।
×