ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিজান মনির

হৃদয়ে চলন সাহিত্য চর্চার মুক্তাঙ্গন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

হৃদয়ে চলন সাহিত্য চর্চার মুক্তাঙ্গন

বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের নিরন্তর চর্চা যেসব মাধ্যমগুলো করে যাচ্ছে, লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ তাদের মধ্যে অন্যতম। ছোটকাগজ সমহিমায় দিন দিন উজ্জ্বলতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যা একটি শুভলক্ষণ। তরুণদের উৎসাহিত করেছে, লেখক তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ছোটকাগজ। ছোটকাগজ করতে গিয়ে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর এ-সব সমস্যাকে ডিঙিয়ে সাহিত্যের জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করছে নতুন প্রজন্ম বা আজকের তরুণরাই। তরুণরা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নতুন নতুন সংখ্যার আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, এটাই বা মন্দ কি। বলা বাহুল্য, তরুণরাই আগামী দিনের কা-ারী। তারুণ্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে নানা প্রতিভা, সৃজনশীল শক্তি। ‘হৃদয়ে চলন’র সম্পাদক নিজেও একজন কর্মঠ-সাহসী তরুণ। সন্দেহ নেই, শিল্প-সাহিত্যই হলো একটি জাতির মানব সম্পদ। সাহিত্যের প্রতি আন্তরিক না হলে কখনও মানসম্মত শিল্প সৃষ্টি হয় না। লিটলম্যাগ ‘হৃদয়ে চলন’ সে রকম একটি আন্তরিক নাম। সম্পাদক দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে বার বার ‘হৃদয়ে চলন’ সবসময়ই নতুন সৃজনশীল লেখকদের অগ্রাধিকার দিতে চায়। মুনাফা নয়, সাহিত্য চর্চায় মুক্তাঙ্গন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েই ২০১৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করেছে ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র তাড়াশের একমাত্র শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোটকাগজ ‘হৃদয়ে চলন’। প্রকাশের ধারা চলমান রেখে প্রকাশিত হলো নভেম্বর, ২০১৭ সংখ্যা। বর্তমান সংখ্যার প্রচ্ছদ খুব চমৎকার, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আর এ কাজটি করেছেন প্রচ্ছদ শিল্পী আল নোমান। সম্পাদক নিজেই প্রমাণ; সংখ্যাটির কাজের প্রতি কতটুকু আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান তা ভেতরে ঢুকলে তা সহজে বুঝা যায়। বিষয় বিন্যাস এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন সত্যিই বিকল্প পথ। সংখ্যাটিতে ৭টি বিষয়কে ৭টি ধাপে স্থান দিয়েছে গোছালোভাবে; যথাক্রমে, প্রবন্ধ, কবিতা, গদ্য, ছড়া, গল্প, অনুবাদ এবং আলোচনা। প্রথম ধাপ: প্রবন্ধ। প্রবন্ধে যাঁরা লিখেছেন ‘নির্জনে স্মৃতির ঘুঙুর’- বজলুল করিম বাহার, ‘জীবনানন্দের চতুর্মাত্রিক রবীন্দ্রনাথ’- শোয়েব শাহরিয়ার, ‘আল মাহমুদের উপন্যাস নরনারীর বিচিত্র হৃদ্যতার সাতকাহন’- কমরুদ্দিন আহমদ। তিনটি প্রবন্ধই সাবলীল ভাষায় মেলা জ্ঞানে ভরপুর। দেশের প্রধান তিনজন জনপ্রিয়-পাঠকপ্রিয় কবিদের সৃষ্টি-কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে (তার মধ্যে দু’জন কবি প্রয়াত)। বর্তমানে একজন জীবিত আছেন। প্রবন্ধগুলো পাঠ করলে পাঠকরা সত্যিই উপকৃত হবে। ‘জীবনানন্দের চতুর্মাত্রিক রবীন্দ্রনাথ’ শোয়েব শাহরিয়ার’র লেখনিতে জীবনানন্দের সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কেও মোটাদাগে ধারণা পাওয়া যায়। ছোট্ট পরিসরে এত বিস্তৃত বিশ্লেষণ বর্তমানের ছোটকাগজে তা খুঁজে পাওয়া বিরল। দ্বিতীয় ধাপ : কবিতা। উপমা-অলঙ্কার ও নতুন নতুন শব্দের গাঁথুনির শিল্পিতরূপে যারা সাজিয়েছেন যথাক্রমে আবদুল লতিফ সরকার, এস. এম. এ হাফিজ, আকাশ মামুন, অপু সরকার, চন্দ্রশিলা ছন্দ্রা, হাবীবুল্লাহ জুয়েল, কামরুন নাহার কুহেলী, যাহিদ সুবহান, নকুল দেব, আরিফা ছিদ্দিকা, সুজান সাম্পান, কাজী শোয়েব শাবাব, সাজিয়া সুলতানা মিম, হিরণ্য হারুন, রাজিব এক্কা রাজ এবং সানজিদা। কবিতা এক ধরনের অনুভূতির লিখিত রূপ। যাকে ধরা বা ছোঁয়া যায় না, কেবল মনের গভীরে ধারণ করা যায়। মানুষের মনের ভেতরে সৌন্দর্যের অনুভব-অনুভূতির অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে আসছে সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই। এ নির্যাস পাঠ ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই উৎসারিত কবিতা। নিজের ভেতর যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় তা অন্যের কাছে প্রকাশ করার মাধ্যম হলো কবিতা। এ সংখ্যার প্রায় কবিতায় এ সময়ের বিচ্ছিন্নতা, গ্লানি, একাকিত্ব ও নৈরাশ্যের পাশাপাশি মিথ-পুরাণের ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাপিত জীবনের বাস্তবতা চিত্রণের অনন্য প্রয়াস লক্ষ্যযোগ্য। তৃতীয় ধাপ : গদ্যে যাদের সৃজনশীল লেখনীর শব্দভা-ারে হৃদয় চলনে মিশে আছে। তারা হলেন শিবলী মোকতাদির, ইলিয়াস বাবর, আলমগীর মাসুদ এবং সিকতা কাজল। গদ্যগুলোতে স্রষ্টারা মনের গভীরের না বলা কথা শেয়ার করেছেন সকল পাঠকদের সঙ্গে। পাঠক পড়া মাত্রই তা বুঝতে পারবেন। মনের না-বলা কথা সাহিত্যের রূপে কত সুন্দর করে সাজানো যায় গদ্যগুলো পড়ে বুঝা যায়। সমাজে কত কত সুবিধাভোগী, মুনাফালোভী মুখোশধারী লোক আছেন, গদ্যগুলোতে এসবের পরিচয় পাওয়া যায়। চতুর্থ ধাপ : ছড়া। ছড়া বাংলা সাহিত্যের আদি বিষয়। ছড়া মানুষকে হাসায় আবার কাঁদায়, আবার শিশুদের ঘুমও পাড়ায়। ছন্দে ছন্দে সুর তুলে যায় ছড়ার শব্দের গাঁথুনিতে। এ সংখ্যার প্রতিটি ছড়ার নিজস্ব গুণ আছে। প্রতিটি ছড়া পড়া মাত্রই পাঠকের মন আনন্দে আন্দোলিত হবে। সাহিত্যে ছোটকাগজে এত এত লেখা থাকলে কেবল হয় না, মান থাকতে হয়। আর এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে ‘হৃদয়ে চলন’ সম্পাদক ছড়া সম্পাদনায়। এর মধ্যে কিছু ছড়া পাঠককে ব্যথিত করে, কিছু ছড়া করে গর্বিত। যারা এত গুণসম্পন্ন ছড়া উপহার দিয়েছেন যথাক্রমে- আবদুর রাজ্জাক রাজু, চন্দনকৃষ্ণ পাল, সাঈদ সাহেদুল ইসলাম, আমির খসরু সেলিম, মেহেরুল সুজন, অপূর্ব কুমার শীল, হাদিউল হৃদয়, মিজান মনির এবং নুরনাহার নিপা। পঞ্চম ধাপ : গল্প। এ সংখ্যায় মাত্র তিনটি গল্প স্থান পেয়েছে। যথাক্রমে ইসলাম রফিকের ‘শিল্পী তুমি কেমন আছো’, শুভ্রা সাহার ‘বিনিসুতার ভালোবাসা’, রোবায়েদ ওসমানীর ‘সাইকো মেয়ের প্রেমে পড়েছি’। তিনটি গল্পই চমৎকার হয়েছে। প্রতিটি গল্পের সংলাপগুলো অসাধারণ লেগেছে আমার, পাঠকেরও মনে দাগ কাটবে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে শুভ্রা সাহার ‘বিনিসুতার ভালোবাসা’ গল্পটি সত্যিই অসাধারণ হয়েছে। ভালোবাসা কত গভীর তা এ গল্প পাঠে সহজে আয়ত্ত করা যায়। তবে গল্পটি অনেক ছোট; লেখক আরও বড় করতে পারতেন। লেখক গল্পটিকে আরেকটু সময় দিতে পারতেন। হৃদয়ে চলনের বর্তমান সংখ্যাটি পড়তে গিয়ে খারাপ লাগেনি। তবে বানানের একটু ত্রুটি আছে। ভুল মানুষের হয়। ভুল থেকেই মানুষ শোধরায়। হয়ত সম্পাদক সাহেবও এর ব্যতিক্রম নয়। জোর দিয়ে বলছি, বেশির ভাগ সময় দিতে সম্পাদনা বা প্রুফ দেখার কাজে। যাতে করে পাঠকরা শুদ্ধ বানানে পড়ে উপকৃত হয়। ষষ্ঠ ধাপ : অনুবাদ। এতে আছে রাশিয়ার প্রখ্যাত নাট্যকার ও ছোটগল্প লেখক অ্যান্তন চেখভ এর একটি গল্পের অনুবাদ। গল্পটির নাম ‘একজন সরকারী কেরানির প্রয়াণ’। প্রত্যয় হামিদের সহজ-সরল শব্দের অনুবাদের সুবাদে পড়তে পারলাম। গল্পটি সত্যিই মর্মস্পর্শী মনে হয়েছে আমার। পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে অনায়াসে। সবশেষে রয়েছে মাসুদ রানার একটি বই আলোচনা। এ আলোচনাটি হচ্ছে আলোকিত বই গোলাম মুরশিদের ‘আলোকিত মুখচ্ছবি’। আলোচনাটি দারুণ হয়েছে। কিছু কিছু লেখায় সম্পাদকের হাত পড়েনি বললেই চলে। সেদিক থেকে বলতে হয়, সামনের সংখ্যাগুলোতে সম্পাদক যেন আরও সতর্ক থাকেন। কেননা এখান থেকে আগামীতে দেশবরেণ্য লেখকরা বেরিযে আসবে এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। ছোটকাগজের যাত্রা এগিয়ে যাক নির্ভয়ে। মেধা ও মুক্তচিন্তার চর্চার বিকাশ ঘটুক এ প্রত্যাশা...
×