ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) সব সময় আমরা তাকে এক এমন জীবন নায়িকা হিসেবে কল্পনা করেছি- যিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে হাতে হাত ধরে এগিয়ে এসে দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কিন্তু সেটিতো একটি আকাশ কুসুম কল্পনা। সবসময় সবার জন্য ফলপ্রসূ হয় না। অতএব আমাদের অন্যভাবে জীবনটাকে সাজাতে হয়েছে। ভিন্নভাবে জীবন বোধ সম্বন্ধে চিন্তা করতে হয়েছে। জীবনকে নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা কোন আরোপিত বিষয় ছিল না আমাদের জন্য। বাঙালী সংস্কৃতি এবং সেই সংস্কৃতির কিছু ধারক এবং বাহকদের সংস্পর্শে এসে আমরা জীবনবোধের এক নতুন দীক্ষা পেয়েছিলাম। এখানে ’দীক্ষা’ শব্দটির প্রয়োগ হয়ত সঠিক হলনা। কেননা এই শব্দে অর্জিত অপেক্ষা আরোপিত হওয়ার একটি ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের তারুণ্যে যখন আমরা নিজের অজান্তেই সংস্কৃতিকে বাহন করে এক ধরনের জাত্যভিমান পুষ্ট অভিযান শুরু করেছি তখন তো কেউ আমাদের বলে দেয়নি এই রকম করতে হবে। কি ওই রকম কর না। সকল বিষয়টি উঠে এসেছিল যে ভূ- খ-ে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং বেড়ে উঠেছি তার নিকট সাহচার্যে। না হলে চাকচিক্যময় ক্রমবর্ধমান পাশ্চাত্য প্রভাবিত শহরে থেকেও গ্রাম বাংলায় গেলে কেন চোখ ভিজে আসত আমাদের? অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এই সময় কিছু আপাত অপ্রাসঙ্গিক কথা উঠে এলে। আমাদের সেই কৈশোর থেকেই শেখানো হয়েছিল কীভাবে রবীন্দ্রনাথ এবং অমুসলমান সব সাহিত্যিক-শিল্পীর বিরুদ্ধে নজরুলকে হাতিয়ার করে এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায়। অথচ সেই নজরুলের যেই গান সর্বদা আমাকে প্রাণিত করেছে তা হলো ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়, হেরিনু পল্লী জননী।’ চোখ ভিজে আসে এমন সে গান। অর্থাৎ বাঙালীর যে সহজাত পেলব অনুভূতি সেটি হয়ে উঠেছে আমাদের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই চেতনার স্ফুরণ সেই তরুণ বয়সের শুরুতে যখন আমরা কলেজে পড়াশোনা আরম্ভ করি। অথচ আমাদের অভিভাবকদের ইচ্ছায় পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সেই শিক্ষালব্ধ শৃঙ্খলায় দীক্ষিত হওয়ার জন্য আমাদের লেখাপড়া করতে হয়েছে মিশনারি স্কুল-কলেজে। সেই বাল্যকাল থেকেই ইংরেজী কবিতা, বাবার মুখে উচ্চারিত, আমাদের প্রভাবিত করার কথা ছিল। ডড়ৎফংড়িৎঃয ছিলেন বাবার সবচেয়ে প্রিয় কবি। যাঁর একটি কবিতা এখনও আমার মুখস্থ আছে, ‘গু যবধৎঃ ষবধঢ়ং ঁঢ় রিঃয লড়ু যিবহ ও নবযড়ষফ ধ ৎধরহনড়ি রহ ঃযব ংশু . ঝড় ধিং রঃ যিবহ সু ষরভব নবমধহ ৃৃৃ ’। অকিঞ্চিতকর এক অনুবাদ হতে পারে এই রকম, ‘আমার হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয় যখন আকাশে দেখি রামধনু এক। কিংবা যখন বিচিত্র বহুবর্ণের দেখা উদ্ভাস আমার জীবন আরম্ভে। অথবা আমি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হলাম যেই দিন। ওই রকমই সে থাকবে যখন আমি বৃদ্ধ হব, কিংবা আমার জীবনের শেষ দিনে। শিশুই হচ্ছে মানুষের আদি পিতা এবং আমার ঐকান্তিক কামনা এই যে, নিসর্গের অপূর্ব শোভায়গাথা থাক আমার জীবনের প্রতিটি দিনই।’ এখন এই জীবন সায়াহ্নে মনে হয় যে নিসর্গই বোধ হয় আমাকে মাটি এবং মানুষের অন্তর্গত নিকটে নিয়ে এসেছিল সেই কৈশোর থেকেই। এই দীর্ঘ জীবনে বহু বর্ণের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে আমার। সেইসব অভিজ্ঞতা ক্রমে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেব এই লেখার মাধ্যমে। (পর্ব- ৫) ১৯৭৪ এ বাংলাদেশে একটি দুর্ভিক্ষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। অবশ্য পঞ্চাশের মন্বন্তরের মতো এই দুর্ভিক্ষ সর্বত্র দেখা যায়নি। ঢাকা শহরে আমরা বুঝতেই পারিনি যে বাংলাদেশ এমন একটি আকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে দুর্ভিক্ষ বিষয়টিকে প্রতিপাদ্য করে রাজনীতি করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বড় দুঃখ লাগে ভাবতে যে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ অনেক বড় বিপর্যয়ের মাঝেও আমাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করে। আমরা অবলীলায় এই সব বিপর্যয়কে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যে ব্যবহার করে থাকি। একটু পেছন ফিরে তাকালে বাংলাদেশের শুরুর কয়েক বছর সম্বন্ধে আমরা সম্যক জ্ঞানার্জন করতে পারব। ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের যুদ্ধ জয়ের ঠিক পূর্বেই বাংলাদেশকে একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে যায় পাকিস্তানীরা। যখন স্বাধীনতা এল তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোন টাকা পয়সা ছিল না। খাদ্য ঘাটতি একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা ঘাটে পণ্য বা জনপরিবহনের জন্য যথেষ্ট যানবাহন ছিল না। অর্থাৎ চারদিকেই একধরনের নেই নেই হাহাকার। এই সময় একই সঙ্গে বাংলাদেশ শিকার হয়েছিল আন্তর্জাতিক দূরভিসন্ধির। স্মর্তব্য যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতাকে কিছু পশ্চিমা পরাশক্তি সুনজরে দেখতে পারেনি। ওই জোটের প্রধান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে তাদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের কিছু তথাকথিত মুসলিম দেশ। এরা আমাদের যুদ্ধের সময় এবং তারপরেও এক ধরনের বিমাতা সুলভ আচরণ করেছিল বেশ কয়েক বছর। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চেষ্টা করেছিলেন ভারসাম্য রক্ষা করে আমাদের দেশটিকে সঠিক গন্তব্যের পথে নিয়ে যেতে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে যে ষড়যন্ত্র সেটি বঙ্গবন্ধু এবং তার সকল সদিচ্ছারও বিরুদ্ধে ছিল। সেই সময় দরিদ্র দেশসমূহকে খাদ্য সহযোগিতা করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চখ-৪৮০ এর অধীনে। সেই খাদ্যের চালান কয়েক সপ্তাহ বিলম্ব করিয়ে দেয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলার সরকারকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য। এই বিলম্বই খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি করেছিল যার কারণে ’৭৪ এর মন্বন্তরটি এড়ানো সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে। আজ তো আমরা জানি যে কেবল দুর্ভিক্ষ নয় আরও অনেক অপকর্ম করার ষড়যন্ত্র করেছিল বাংলাদেশ বিরোধী এই আন্তর্জাতিক চক্রটি। যার ফলে পরবর্তীতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে। ওই সময় কি তার পরেও আমরা একটি বিষয়ে সচেতন ছিলাম আর সেটি হলো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিংবা পরবর্তী সময়ে আমাদের যার যা ভূমিকা তাই আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করব। যা আমাদের কাজ নয় তা নিয়ে আমরা বিচলিত হব না। আমাদের এই সমাজে সব সময়ই কিছু মানুষ সব ব্যাপারেই নাক গলানোর চেষ্টা চালায়। তারা যখন আমাদের রাজনীতির অভ্যন্তরে নানা রকম ষড়যন্ত্র খোঁজার চেষ্টা করতেন এবং আমাদের সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতেন আমরা বলেছি যে আমরা জানি না। আমরা কেবল আমাদের কাজটি বুঝি। আমাদের যার যা ভূমিকা সেটি সঠিকভাবে পালন করতে পারলে তাতেই আমাদের এবং আমাদের দেশের মঙ্গল। (শেষ)
×