ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়ের ২ টি কবিতা

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বদেশ রায়ের ২ টি কবিতা

* কীর্তনখোলা কীর্তনখোলার জোয়ারের স্রোতে ভেসে চলে দুকুলে ঝরে পড়া লাল গাব ঘন সবুজ গাছের নরম বুক থেকে রাতের শিশিরের মতো সারা দিন ঝরে পড়ে তারা। শ্রাবণের আকাশ তখন অনেক নিচু হয়ে বৃষ্টি ঝরায় কীর্তনখোলার বুকে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণ হয় কিনা ঝরে পড়া গাবের শরীর- কেউ জানে না তা। এই বৃষ্টিতে একদিন নাকি ইলিশ নাচতো এই কীর্তনখোলায়। তখন কি জীবানানন্দ বর্ষায় ভিজে ভিজে হেঁটে যেতেন কীর্তন খোলার পাশ ধরে- নরম ঘাস দু’পায়ে মাড়িয়ে? বৃষ্টিতে কতটা কাবু হতেন জীবনানন্দ দাশ, তার থেকে বেশি কাবু কি তিনি হননি কলকাতার পাকা রাস্তায় দুপুরের রোদে ঘুরে ঘুরে? কলকাতার রাস্তায় মরে পড়ে রইল জীবনানন্দ, তাঁর শাদা ধুতি লাল হয়ে গেলো রক্তে, যেমন একদিন কীর্তন খোলার জল লাল হয়েছিল ভাইয়ে ভাইয়ে হত্যার উৎসবে। সেদিনও কী লাল গাব ভেসে গিয়েছিল কীর্তন খোলার জলে। অশ্বিনী দত্তের দেহ তার অনেক আগে ছাই হয়েছিল- সেদিন কি ভস্ম হয়ে গিয়েছিল? লাল গাব তবু ভেসে চলে কীর্তনখোলার জলে। কেটে যায় অনেক সময়। কলকাতা থেকে আসা জীবনানন্দের মৃত্যুর সংবাদ ফিকে হয়ে যায়। তারপরেও আবার কীর্তনখোলার পাশে হত্যার উৎসব হয়, আহা! বাঙালীর ঘাম কেমন বুলেট হয়ে ফেরে বাঙালীর বুকে। গুলিতে গুলিতে মরে মানুষ, ঝরে পড়া বকের মতো ভাসে তারা কীর্তন খোলার বুকে। তবে কেউ নয় তারা ধবল বক, যারা ফেরে সন্ধ্যায় নীড়ে। সেদিন কীর্তন খোলার পাশের কোন নীড়ে সন্ধ্যায় জ্বলেনি কোন আলো। বুলেটের শব্দের পরে কোন ধবল বক ফিরেছিল কিনা নীড়ে, তাও দেখেনি কেউ। তখন গাবের নিবিড় বুকে কেবলই ফুল, শ্রাবণও ছিল অনেক দূরে- আকাশ তাই নামেনি নিচে। কীর্তন খোলায় লাল গাব নয় কেবলই ভেসে গিয়েছিল লাল রক্তমাখা মানুষের দেহ। সেই সব দেহ কবে পচে গলে গেছে। মানুষের ইতিহাসে মানুষ নয় আরেক এক শব্দ ‘শহীদ’ নামে পরিচিত তারা। তাদের স্মরণে শহীদ মিনারে দেয় অনেক ফুল, কীর্তন খোলায় ভেসে যায় ওই ফুলের মরা পাপড়ি, তার সঙ্গে মিশে যায় লাল গাবের দেহ। হায়! তবুও শুধু সূর্যের আলোয় বা শ্রাবণের বৃষ্টিতে নয় গভীর রাতেও কুল কুল শব্দ তুলে বয়ে যায় কীর্তনখোলা। কোন হেমন্তের রাতে শাদা কুয়াশার জাল দেখে, কোন কবি কিশোর ভাবে কি- জীবনানন্দ দেখিতেছে আজো কুল কুল বয়ে চলেছে তাঁর কীর্তনখোলা- মাথার ওপরে হীম পড়িতেছে গলে। . * মানুষের সুগন্ধ আমাদের মৃত্যুগুলো কোন রাত্রির অন্ধকার থেকে উৎসারিত? খোঁজ মেলে কি ওই রাত্রির অন্ধকারের কোন দিগন্ত রেখার? সেখানে বালক মন হেঁটে গিয়ে থেমে যেতে পারে নিশব্দ শরীর নিয়ে। দিগন্ত রেখা ছুঁতে ছুঁতে আরও দূরে চলে যাবে- মৃত্যুগুলো ভেসে ভেসে চলে যাবে আকাশের অনেক ওপরে, যেখানে অন্ধকার আর আলোর পাশাপাশি বসবাস। মৃত্যুরা হালকা পালকের মতো ভেসে যাবে, হবে না কোন ভারি হীম পাহাড় বা কোন বরফাচ্ছাদিত হাজার বছরের ফসিলের মতো। বরং ফুলের সুগন্ধ যেমন ভেসে যায় আকাশের অনেক দূর ঠিকানায়, মৃত্যুগুলো ভেসে যাবে অন্ধকারের আলোর ভেতর দিয়ে। মৃত্যুতে কেন শেষ হয়ে যাবে জীবনের দেনা, মৃত্যু কেন হবে না জীবনের এক দিগন্ত রেখা - যাকে আর কেউ কোন দিন পাবে না ছুঁতে- বরুণ বকসি ইচ্ছে করলেও গার্গীর হাত পাবে না ধরতে- কেবলই সে বালকের মতো এগিয়ে যাবে অন্ধকারের দিগন্ত রেখার দিকে। মানুষের জীবনে অনেক শিলালিপি লেখা হয়, তারপরেও এই সব ঘটনা কেন এসে ভিড় করে, কেন একটি উষ্ণ হাত একটি শীতল হাতের ওপর পড়ে? গভীর অন্ধকারের শন শন হাওয়ার মতো কেন মৃত্যুরা এসে মায়াবী চুমু খেয়ে চলে যায়, পৃথিবীতে বয়ে চলা নদীর মতো মানুষের মুখে! কেন মৃত্যু শুধু হীম হয়ে যায়? হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যাওয়া গভীর রাতের ফুলের সুগন্ধীর মতো- মৃত্যুও যায় না ভেসে সুগন্ধ ছড়িয়ে চারপাশে। মানুষের কত সুগন্ধ আছে তা অন্তত একবার ফুলেরা জেনে যাক সেইসব গভীর নিস্তব্ধ অন্ধকার মুহূর্তে।
×