ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আতাউল হক মাসুম

হাসান আজিজুল হকের গল্পে মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

হাসান আজিজুল হকের গল্পে মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোতে দেশের তরুণ ছেলেরা প্রাণপণ ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুসেনার ওপর। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভীষণ ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরতে না পেড়ে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। অবলা নারী, অবোধ শিশু নিস্তার পায়নি তাদের কালো থাবা থেকে। মৃত্যুপণ সাধনা শেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন বাংলার দামাল ছেলেরা। আনন্দ উৎফুল্লে দেশের মানুষ ভুলে গেছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো আহত মুক্তিযোদ্ধাদের, জীবনের বিনিময়ে যারা দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন তাদের। তাঁদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় মেলেনি লোকের। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা করে যারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক অন্যতম। বাংলা কথা সাহিত্যে হাসান অজিজুল হক এক প্রবাদপ্রতিম নাম। তিনি বাঙালী সাহিত্যপ্রেমীদের মন-মননে বাংলা ছোট গল্পের রাজপুত্র হিসেবে অধিষ্ঠিত। বরেণ্য এই কথা সাহিত্যিকের জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে, পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলায়। ছাত্র জীবনেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকের অধিকারী তিনি। ১৯৬০ সালে শকুন গল্প রচনার মাধ্যমে আলোচিত হন হাসান আজিজুল হক। সে হিসাবে তাঁর সাহিত্য চর্চার অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পসমূহকে দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গল্প আর মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের গল্প। ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, কৃষ্ণপক্ষের দিন’- গল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। আর যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অবস্থাক্রমে বর্ণিত হয়েছে ‘আটক’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’ ও ‘ঘরগেরস্থি’ তে। ‘ভূষণের একদিন’ গল্পে দেখা যায়- পাকিস্তানী সেনার তা-বের শিকার হয়ে, দুচোখে বিস্মিত জিজ্ঞাসা নিয়ে কিভাবে প্রাণ হারিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের এমন সব শ্রমজীবী মানুষ, যারা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কি তা জানতই না। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ছোট্ট জমিটিতে শ্রম দেয় ভূষণ নামের এক কৃষাণ। অন্যের জমিতে অক্লান্ত খেটেও অভাব ঘুচাতে না পেরে বছরের বাকি সময় তাকে অন্য কাজের সন্ধান করতে হয়। বাড়ির ছোট্ট আঙিনায় ফলানো কাঁচকলা, লাউশাক ও দুটি লাউ নিয়ে শালতি বেয়ে হাটে যায় ভূষণ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ানো ছেলে হরিদাসকে দেখে মেজাজ চড়ে যায় তার। জিভের ডগায় জমে ওঠে গালিগালাজের অশ্রাব্য ভাষা। হঠাৎ হাটে আসা লোকজনের কোলাহল, হাঁকডাক, বিচিত্র শব্দের মাঝে ছাপিয়ে ওঠে তীক্ষè ধাতব শব্দ গুম্্-ম্্-ম্, চাঁই-ই-ই, র্ফ্র্-র্-....। দুই চোখে পাশব হিংস্রতা নিয়ে নদীর পাশ থেকে উঠে আসে খাকি পোশাক পরা একদল হানাদার। একটানা কট্্কট্ কট্কট্ শব্দের সমান্তরালে হাটে আসা মানুষেরা লুটিয়ে পড়তে থাকে মাটিতে। দেহের নানা স্থান থেকে তাদের ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। চিৎকার করতে করতে মানুষ জন ছোটাছুটি শুরু করে, কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, হাতের ফাঁকফোকর গলে গড়িয়ে পড়ছে টকটকে লাল রক্ত। ছটফট করতে করতে কেউ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থির হয়ে যায়। কেউবা একটু নড়ে ওঠে, চোখের পাতা কেঁপে ওঠে অস্ফুট স্বরে পানি চায় কেউ। ভীত-বিস্মিত ভূষণ ছেলেকে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিশু কোলে কোত্থেকে ছুটি আসে এক যুবতী মেয়ে। ‘ঠাস্্ ঠাস্্’ শব্দের সঙ্গে শিশুর রক্তে হাত ভরে যায় তার। পড়ে যায় পাশে দাঁড়ানো হরিদাসও। এক বন্দুকধারী ভূষণকে জিজ্ঞেস করে- ‘এ কমিন, তুম মালাউন হো?’ কিছু বলার আগেই ‘কড়াং’ করে এক আওয়াজের সঙ্গে বারদুয়েক ঝাঁকি দিয়ে পরপারে চলে যায় ভূষণও। ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পের মূল চরিত্রে দেখা যায় ঘরে ফেরায় ব্যাগ্র-ব্যাকুল এক পথচারী। চেনা শহরে পৌঁছে সে অচেনা অনুভবে আক্রান্ত হয়। রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট বন্ধ, বাড়িঘরগুলোর তো যেন দাঁতকপাটি লেগেছে। নিঃশব্দ অন্ধকারের বুক চিড়ে বুটের শব্দ ওঠে। রাইফেল থেকে একটি-দুুটি গুলিও ছোটে। দ্রুত রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য পথ ধরে পথচারী। কখনও বা হেঁটে চলে গোলকধাঁধার মতো গলিরাজির পথ ধরে। কেন্নোর মতো সিঁড়ি বেয়ে ওঠে পড়ে অন্ধকার কোন দোতলা বাড়িতে। কড়া নেড়ে নেড়ে কার সাড়া না পেয়ে আবার পথে নামে। জিপের শব্দ শুনে কোন বাড়ির ঘুপচিতে নিজেকে আড়াল করে নেয় সে। শ্লথ গতি জিপটির ভেতর থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের গোঙানির শব্দ। একটা গালির মধ্যে ঢুকে সে দেখতে পায়- ধরে আনা কোন মানুষের সঙ্গে চলছে পাকিস্তানী সেনার জিজ্ঞাসাবাদ। ‘তুম হিন্দু হো’? ‘জরুর তুম হিন্দু হো’? ‘শালা বোলো, তুম জয় বাংলা হো’? ‘জরুর জয় বাংলা হো’? ‘বাঙালী কুত্তা,’ ‘শালা মুজিবকা পুজারি’। ধৃত মানুষটির দুই পা বাঁধা, দড়ির অন্যপ্রান্ত পাশের একতলা বাড়ির ছাদের লোহার রডে প্যাঁচ দিয়ে হাতে ধরে রাখা হয়েছে। কপিকলের মতো টান দিয়ে তাকে ওপরে তুলে ফের চলল প্রশ্নের পর প্রশ্ন- ‘জয় বাংলা কাহা হ্যায়’? ‘তুম মুক্তিফৌজ হো’? প্রতিটি প্রশ্নের ‘না’ উত্তরের পর টেনে রাখা দড়ি ছেড়ে দিতে লাগল অন্য সৈনিকটি, আর শরীরের সব ওজনসহ রাস্তায় পড়ে প্রচ-ভাবে ঠুকে যেতে থাকে তার মাথা। এ গলি সে গলি ঘুরে অবশেষে নিজের বাড়ি এসে পৌঁছে পথচারী, যেখানে রয়েছে তার স্ত্রী ও আট বছর বয়সী সন্তান। ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে শূন্য ঘরগুলোয় তাদের সন্ধান করে সে। অবশেষে উঠানের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পায় তার সন্তানের পাঁজরের হাড়। হাতের অস্থি, হাঁটুর নলি, পায়ের পাতা। দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কণ্ঠাস্থি, প্রশস্ত নিতম্বের হাড়, করোটি দেখে স্ত্রী মমতাকে শনাক্ত করে সে। পুনরায় সে কোদাল চালায়। যেন পৃথিবীর নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ বের করে আনতে চায়। রাজাকারের হাতের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্য দিয়ে পাঁচজন গেরিলা যোদ্ধার পলায়নপরতার বিবরণ রয়েছে ‘কৃষ্ণপক্ষের একদিন’ গল্পটিতে। পাকিস্তানী সেনার চোখ এড়িয়ে ছুটতে ছুটতে তারা খালের জলে এসে নামে। প্রায় বালক বয়সী একরাম চলতে অপারগ হলে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে এখানে জীবিত রেখে যাওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় জামিল নামের একজন। ফেলে আসা গ্রামের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেশিনগানের বিরতিহীন আওয়াজ। সেই সঙ্গে চলছে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, আতঙ্কিত মানুষের আর্তচিৎকার। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, ধরে আনা লোকদের সারি বেঁধে দাঁড় করানো হচ্ছে খালের ধারে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এক নারীকে নগ্ন করছে কয়েকজন। হঠাৎ তার গগনবিদারী চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠে। পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবল গেরিলারা। তখনই কপালে গুলি লেগে নিথর হয়ে যায় একরাম। যদিও একটু আগে তারাই মেরে ফেলতে চাচ্ছিল, তারপরও দুচোখ জ্বালা করতে থাকে জামিলের। সৈনিকগুলো চলে গেলে খালের পাড়ে মৃতের সারির মধ্যে একরামকে শুইয়ে দিতে দিতে মতিউরের নজর পড়ে নিথর হয়ে থাকা নারীটির দিকে। চুলের রাশিতে ঢাকা পড়ে আছে মুখ। নিস্পন্দ হয়ে আছে তার উঁচু গর্ভদেহটি। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নারীর লজ্জা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে নরপিশাচরা। অস্ত্রসহ গভীর খাল সাঁতরে পাড়ি দিয়ে উপারে নিরাপদে পৌঁছায় বাকি চার গোরিলা। শরীরের ওপর দিয়ে সীমাহীন ধকল যাওয়ায় ক্লান্তিতে ঝোপের আড়ালে তারা শরীর এলিয়ে দেয়। আর ঠিক তখনি জনপনেরো পাকিস্তানী সেনা এসে তাদের ঘিরে ধরে। পথ ভুল করে গ্রামের দিকে না গিয়ে গঞ্জের দিকে চলে এসেছে তারা! হাসানের ‘আটক’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত স্তরে, পাকিস্তানী বাহিনীর কোণঠাসা হয়ে পড়া ও বাংলার স্বাধীনচেতা মানুষের উৎফুল্লের বিবরণ। আকাশে যুদ্ধ বিমানগুলোর ইতস্তত উড়াউড়ি দেখে এখন আর ভয় পায় না লোকে। বরং মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিমানগুলোর খেলা দেখে মজা পায় নানা শ্রেণীর মানুষ। ডালপাতায় শরীর ঢেকে চলন্ত জঙ্গলের মতো শহরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে পাকিস্তানী বাহিনীর সাঁজোয়া যানগুলো। রাতের বেলা তারা গাড়ির বাতি নিভিয়ে চুপিসারে যাতায়াত করে। মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানী সেনাদের দুর্গতি উপলব্ধি করে জনতার মধ্যে চলে নানান জল্পনা-কল্পনা। ভোর হতেই আকাশে উড়ে মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো। কখনও বিকট শব্দে কান ঝালাপালা করে নেমে আসে অনেকটা নিচে। পাকিস্তানী সেনারা তখন চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে পথের পাশে লুকায়। হান্টার বিমানগুলো মুহূর্তেই ওপরে উঠে যায়। দু-বার চক্কর দিয়ে ঈগলের মতো আবার নেমে আসে। চারদিকে কাঁপিয়ে আওয়াজ ওঠে বুম-ম্-ম্। পাটের গুদামে বোমা ফেলেছে মিত্র বাহিনী। সেখানে পাট ছিল না, কয়েকজন হানাদার আত্মগোপন করেছিল। উৎসাহী জনতা ছুটি গিয়ে রক্ত মাংসে একাকার ছিন্ন ভিন্ন দেহগুলো দেখে। পরে তারা বলাবলি করে- ‘বিকেলের আগে আজ আর প্লেন দেখা যাবে না।’ চরম অবহেলা আর অযতেœর মধ্যে হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকা আহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধার মর্মন্তুদ কাহিনী ফুটে উঠেছে ‘কেউ আসেনি’ গল্পে। দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানগাড়ি থেকে মৃতদেহগুলো স্ট্রেচারে করে এনে বারান্দার এক কোণে স্তূপ করে রাখা হচ্ছিল। বিরক্তি প্রকাশ পায় কর্মরত লোকদের নানা মন্তব্যে- ‘আরি শালা, কি পেছ্লা। এই মড়াগুলানরে কী কামে বয়ে আনিছে’? স্তূপের মধ্য থেকে হঠাৎ কেউ নড়ে উঠলে লোকগুলো গিয়ে তাদের পৃথক করে রাখে। যুদ্ধে এক পা খোঁড়া হয়ে যাওয়া গফুর হাসপাতালে এসেছিলেন সহযোদ্ধা আসফ আলীর খোজ নিতে। আহতদের মধ্যে হঠাৎ আসফ আলীকে খুঁজে পায় গফুর। ডাক্তার আসফ আলীর ক্ষতস্থান পরীক্ষা করার জন্য প্যান্ট খোলার চেষ্টা করে । কিন্তু রক্তে চপচপে হয়ে উরুর কাছে আটকে আছে প্যান্টটি। চড়চড় করে একটানে খুলতেই আর্তচিৎকার করে উঠে আসফ আলী। ডাক্তার জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখলো একটা গোল ফুটোর ভেতরটা কুচকুচে কালো। চারপাশে রক্ত শুকিয়ে কামড়ে বসে গেছে। ‘কাল-পরশু নাগাদ অপেক্ষা না করে কিছু বলা যাবে না’- জানিয়ে চলে যান ডাক্তার। সকাল বেলার স্পষ্ট আলোয় আসফ আলীর ক্ষতস্থান আবার দেখেন ডাক্তার। মাংস পচে গন্ধ বের হচ্ছে। কেটে বাদ দিতে হবে পাটা। চোখ মেলে গফুরকে চিনতে পেরে তাঁর হাতটা চেপে ধরেন আসফ আলী। অস্ফুট স্বরে জানতে চান সে বাঁচবে কিনা, তাকে দেখতে কেউ এসেছিল কি না, দেশ স্বাধীন হয়েছে কি না! বিড় বিড় করে বলতে থাকেন- তাঁকে কেউ বলেনি, দেশ স্বাধীন হয়েছে মা তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিলেন। গফুর যেন তাঁর মাকে গিয়ে বলেন, লড়াই করতে করতে তাঁর সন্তানের মৃত্য হয়েছে। অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে আসফ আলী জানতে চান ‘ঠ্যাং কাটে ফালায়ে দিইছে? কাটা ঠ্যাংটা কনে ? আমার ঠ্যাং আনে দিতি কও , আমি দ্যাখপো। আমার ঠ্যাং নে বাড়ি যাবো, আমার মারে দ্যাখাপো।’....এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই গফুরের। ডাক্তার এলে তাকেও জিজ্ঞেস করে আসফ আলী। ‘আমার ঠ্যাং কাটিছো ক্যানো? আনে দ্যাও, আমার জিনিস আমারে আনে দ্যাও’।.... ডাক্তার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিকেলের দিকে পরপর হিক্কা তুলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আসফ আলী। নার্স এসে গায়ের কম্বলটা টেনে দেন আপাদমস্তক। পাশের বেডের আহত লোকটি কনুইতে এর দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় মাথা তুলে দেখতে চান, আর কি যেন বিড় বিড় করেন! আসফ আলীর বৃদ্ধ মায়ের জন্য সুনিশ্চিত খবরটি নিয়ে গাঁয়ের পথে পা বাড়ান গফুর। প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধার মানস-রূপান্তেরের ধারাক্রম বর্ণিত হয়েছে- ‘ফেরা’ গল্পে। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আলেফ। নানা-মাত্রিক হতাশা যন্ত্রণায় জর্জরিত নেতিবাচক পরিণতিতে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এ গল্পের মূল উপজীব্য। যুদ্ধক্ষেত্রে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় আলেফের। গুলি বের করার পর ছেঁড়াখোঁড়া মাংসগুলো জড়ো করে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। আর একটু উপরে গুলি লাগলে গোটা পা-ই কেটে ফেলতে হতো। ছেলেকে জীবিত ফিরে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়েছে আলেফের জননী। ছেলের পয়ের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত দেখে শিউড়ে ওঠেন জননী- ছেলের প্রাণটাও যে চলে যেতে পারত! মুক্তিযোদ্ধা আলেফের অঙ্গীকারের দিকে আলোকপাত করলে পরিষ্কার হয়, মানুষ যে কোন যুদ্ধ অস্ত্র দিয়েই করে, কিন্তু তার সেই যুদ্ধের জন্য তার ‘চেতনা’ যদি মস্তিষ্কের কোষে কোষে সজীব না থাকে, তাহলে সেই যুদ্ধ একটা যান্ত্রিকতা ছাড়া আর কিছু দেয় না। আলেফ ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিল। এইটুকু মাত্র বিদ্যা সম্বল করে সে দেশ, যুদ্ধ, জনগণ প্রভৃতি কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হীনম্মন্যতায় ভোগা লোকের হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে ‘আমি যুদ্ধে গিইলাম ক্যানো?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাসান লিখেছেন ‘কঠিন কথা ভেবে দেখার সময় লোকের যেমন ভ্রু কুঁচকে উঠে, চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আলেফের ভ্রুতে তেমনিই গিট পড়ে , আর তেমনিই শক্ত হয়ে যায় তার চোয়াল, ‘দেশের জন্যি যুদ্ধে গিইলাম’। একদিকে স্বপ্ন অন্যদিকে দগদগে ঘা, লাশের গন্ধ; ‘ফেরা’ গল্পে লেখক মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কঠিন দিনগুলো অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। জীবনে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে হাসি ঠাট্টাও মিলেমিশে থাকে। আলেফ যখন রাইফেল মিছেমিছি মা আর বউয়ের দিকে তাক করে ‘টারাটারা’ শব্দ করে অর্ধ বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আনে, ভয়ে বউয়ের মুখ শুকিয়ে যায়। মায়ের মুখের ভাব সে ধরতে পারে না। মা চলে গেলে আলেফ বউকে ডাকে। অভাবের তাড়নায় না খেতে পেয়ে বউ চলে গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে। কিন্তু এখানে থাকলে সে সত্যিই খেতে পাবে কিনা এ প্রশ্ন তো থেকেই যায়। সেই কঠিন প্রশ্নই শেষ পর্যন্ত করে বসে আলেফ। বউ আর তাকে ছেড়ে যাবে না, অনেক কষ্ট হলেও তার কাছে থাকবে, বলতে বলতে সে ঝরঝর করে কাঁদে, কিন্তু আমরা তার প্রত্যয় টের পাই। হয়ত টের পায় আলেফ নিজেও। তাই সরকার থেকে যখন জারি করা হয়েছে, তিন দিনের মধ্যে যার যা অস্ত্র আছে সব জমা দিতে। কিন্তু আলেফ উপলব্ধি করে যুদ্ধ কখনও থেমে থাকে না, কেবল দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তাই অস্ত্র জমা দেয়া যাবে না। আলেফ রাইফেল হাতে বাড়ির পেছনের ডোবার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর গায়ের সমস্ত বল দিয়ে রাইফেলটা ডোবার মাঝখানে ছুড়ে দেয়। ‘ডোবাটা ছোট- রাইফেলটা খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হবে না।’ এই কথায় শেষ হয় ফেরা গল্প, কিন্তু আলেফের আকাক্সক্ষাটা অসমাপ্ত রেখেছেন লেখক। শরণার্থী-জীবন শেষে নিজের ভিটেয় ফিরে আসা এক পরিবারের ফের অসহায়ত্বের তথ্যনির্ভর বিবরণ মেলে ‘ঘরগেরস্থি’ গল্পে। দেশ স্বাধীন হতেই এক বুক স্বপ্ন নিয়ে গাঁয়ে ফিরে এসেছিল রামশরণ পরিবার। স্বাধীনতার আগে অভাব ছিল, ভারতে যাওয়ার পরও তা পিছু ছাড়েনি, চিরসঙ্গী সেই অভাব এখনও যে লেগে থাকবে তারা তা জানে। তবু নিজের ভিটে বলে কথা। রিলিফের সের সাতেক চাল ও ভারত সরকারের দুটি কম্বলসহ ফিরে আসা এই পরিবারটি ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল এক বছর আগে। রামশরণের চোখের সামনে দিয়ে দড়ি খুলে তার দুধেল গাভিটি নিয়ে গিয়েছিল ওপাড়ার রশীদ। দুপুরে ভাত খেতে বসার পর, চেনা-অচেনা কিছু যুবক এসে কাঁসার থালাটিসহ তুলে নিয়ে গেল কাঁসা-পেতলের ঘটিবাটিগুলো । পশ্চিম বাড়ির হৃদয়চরণের খড়োঘরে আগুন নিয়ে তাঁকে পুড়িয়ে মারলো কারা যেন। কয়দিন পরই মিলিটারি এসে জ্বালিয়ে দিল গোটা সংখ্যালঘুপাড়াটি। রামাশরণ পরিবার তার আগেই ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। নয় মাসের উদ্ধাস্তু জীবন শেষে এবার নিজেদের ভিটের ফিরছেন তাঁরা। কে জানে বাড়িটা তাঁদের কি অবস্থায় আছে! গাছ গাছালি, লাউ-কুমড়োর মাচাসহ সব কি তেমনি আছে! নাকি সব মরে নষ্ট হয়ে গেছে? নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে এক সময় রামশরণ ও ভানুমতী পৌঁছে যান তাঁদের গ্রামে। কিন্তু কোথায় সেই গ্রাম? অজন্ম চেনা পাড়াটির চিহ্ন নেই কোথাও। কোনটা যে তুলসীদার ভিটে, রিদয় খুড়োর, পেল্লাদের, কোনটাই বা তাদের- কিছুই ঠাহর করতে পারে না রামশরণ। জলচোখে রামশরণের আর্তনাদ- ‘ভিটেটা গেল কনে ? আঁ? অ ভানু, দ্যাখ না এট্টু খুঁজে’। রিলিফের চাল ফুটিয়ে সন্তানদের খাওয়ানোর পর ভানুমতী খেয়াল করেন ছোট মেয়ে অরুন্ধতীর কোন সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চিন্ত ঘুমের মতো মরে রয়েছে সে। কান্নারত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রামশরণ ভাবেন সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে রাঁধা ভাতগুলো কি এখন ফেলে দেবেন? মৃত্যু শোকের চেয়ে তার যে ক্ষুধার তীব্রতাই বেশি অনুভূত হচ্ছে! সবাইকে খেতে দিয়ে চোখের জলে মাখামাখি হয়ে যাওয়া ভাতের গ্রাস মুখে তোলেন ভানুমতী। খোলা আকাশের নিচে রাত শেষ হয় পরিবারটির। রাত থাকতেই মেয়েটার সৎকার পর্ব শেষ করেছে দুটো শেয়াল। কাঁদতে কাঁদতে ভানুমতীর ছেলের কথাও মনে পড়ে যায়- কেমন করে আমার দুলাল মরিছে তোমার মনে নাই? ছেলেডা ইন্ডেয় শুকিয়ে মলো- জংগলে চেলে ফেলে দেলাম। কথা বলতে গিয়ে রামশরনের গলা চিড়ে যায়- ‘স্বাধীন হইছি তাতে আমার বাপের কি? আমি তো এই দেহি, গত বছর পরাণের ভয়ে পালালাম ইন্ডেয়- ন’টা মাস শ্যাল কুকুরের মতো কাটিয়ে ফিরে আলাম দ্যাশে। আবার সেই শ্যাল কুকুরের ব্যাপার।....‘স্বাধীনটা কি আঁ’? আমি খাতি পালাম না- ছোওয়াল মিয়ে শুকিয়ে মরে, স্বধীনটা কোঁয়ানে’? ইটের তৈরি উনুনটা ভেঙে দিয়ে বহন যোগ্য সংসারটাকে হাতে নিয়ে ছেলে মেয়ে দুটিসহ রামশরণ ও ভানুমতী উঠে দাঁড়ায়। লঞ্চ ঘাটের পাশ দিয়ে তারা কোন অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়, কে জানে!
×