ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববাঙালীর মিলনমোহনা!॥ একুশের বইমেলা

প্রকাশিত: ০৩:১১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিশ্ববাঙালীর মিলনমোহনা!॥ একুশের বইমেলা

বাঙালীর যে ক’টি উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তার মধ্যে মধ্যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অন্যতম। ব্যক্তির স্বপ্নের সার্বজনীনতায় অনন্যতা পাওয়া এই মেলা কালপরিক্রমায় বিশ্ববাঙালীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র বইমেলাকে কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী ঠিক যতসংখ্যক লেখকের আগমন ঘটে দেশে আর কোনও উৎসব বা মেলাকে কেন্দ্র করে এমনটি ঘটে না। একদিকে বিশ্ববাঙালীর উপস্থিতি অন্যদিকে দেশের সব অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং পাঠকের অংশগ্রহণে আমাদের বইমেলা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, পরিণত হয় মিলনমোহনায়। ভাষার মাসের এই মেলা শুধু আত্মিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতেই নয়, সম্প্রীতির বাতাবরণ মেলে ধরতে পালন করে অনন্য ভূমিকা। পৃথিবীব্যাপী অসহিষ্ণুতার এই সময়ে যাকে আমরা সহজেই অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনের মেলা বলে আখ্যায়িত করতে পারি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় একুশের বইমেলা আজ পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ মেলায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বে মাসব্যাপী বইমেলা আয়োজনের এমন নজির আর কোথাও নেই! বইমেলা পয়তাল্লিশ পেরিয়ে ছিচল্লিশে পয়তাল্লিশ বছর অতিক্রম করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা এ বছর ছিচল্লিশ বর্ষে পদার্পণ করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরের বছর চিত্তরঞ্জন সাহা যে বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন সেটি এখন পরিপূর্ণ। বাহাত্তর সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে তিনি যে যাত্রাপথের সূচনা করেছিলেন তা শুধু সার্বজনীনতাই অর্জন করেনি, বাংলাসাহিত্যের অগ্রগতিতেও রাখছে ভূমিকা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা একাই চালিয়ে যান বইমেলা। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সালে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৪ সালে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। গুটিকয়েক প্রকাশক নিয়ে যে মেলার যাত্রা হয়েছিল কালপ্রবাহে আজ তা অর্জন করেছে বিশালতা। বেড়েছে পরিসর, বেড়েছে স্টলের সংখ্যা গতকাল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠেছে ২০১৮ সালের বইমেলার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন মাসব্যাপী এই উৎসবের। এবারের বইমেলা বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে সবদিক থেকে এমন আভাস দিয়ে রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাড়ানো হয়েছে মেলার পরিসর। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় পাঁচ লাখ বর্গফুট জায়গায় এবার মেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের সুবিধার্থে ১২টি চত্বরে বিন্যস্ত করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশকে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জানান, একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৩৬টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩৬৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৮৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট ২৪টি প্যাভিলিয়ন। এবার লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে ১৩৬টি লিটল ম্যাগাজিনকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক লাখ বর্গফুট এলাকায় ইট ও বালু দিয়ে অস্থায়ী রাস্তা এবং উন্মুক্ত প্রান্তর তৈরি করা হয়েছে। শিশু চত্বরেও বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে সংযোজন করা হয়েছে শিশু চত্বর। বিগত বছরের ন্যায় এবারও শুক্র ও শনিবার সকাল ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হয়েছে। রাখা হয়েছে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যবস্থা। এবার মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে এক ঘণ্টা। ৮ টার পরিবর্তে মেলা চলবে প্রতিদিন রাত ৯ টা পর্যন্ত। অনন্য বছরের তুলনায় অত্যধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে এ বছর। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, বইমেলার ভেতরে ও বাইরে পর্যাপ্ত সংখ্যক সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে পুলিশ ডিউটিতে নিয়োজিত থাকবে। স্ট্যান্ডবাই থাকবে সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড। মেলার প্রাঙ্গণ ডগ স্কোয়াড ও এসবি দিয়ে সুইপিং করানো হবে। শাহবাগ, বকশীবাজার, নীলক্ষেত ও দোয়েল চত্বর ঘিরে থাকবে পুলিশে বহিঃবেষ্টনী নিরাপত্তা বলয়। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকবে আন্তঃবেষ্টনী নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উভয় বইমেলা চত্বর সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রাণের টানে ছুটে আসা একুশে বইমেলায় যারা আসছেন তাদের অধিকাংশই আসেন প্রাণের টানে। লেখক-পাঠকের মিলনমেলার আনন্দকে উপভোগ করতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী বাঙালীরা ছুটে আসেন বাংলাদেশে। এবারও এর ব্যত্যয় হবে না। বইমেলায় অংশ নিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, ভারতসহ বিশ্বের বিভন্ন দেশে বসবাসকারী শত শত লেখক, পাঠক দেশে আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেও গেছেন কেউ কেউ। ঐতিহ্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে বইমেলাকে অন্যতম প্লাটফর্ম মনে করেন প্রবাসীরা। অন্যান্য বছরের মতো এবারো বইমেলায় আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন আমেরিকা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী, লেখক ড. নুরুন নবী। তিনি বলেন, দেশে এতবড় একটি মেলার আয়োজন হবে, আর আসব না তা-কি হয়! নিশ্চয়ই না। তাই ছুটে আসি দেশে। এবারও আসবো। মধ্যবর্তী সময়ে সম্পৃক্ত হবো উচ্ছ্বাসভরা প্রাণের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিশ্বে মাসব্যাপী এমন বইমেলার নজির আর একটিও নেই। সরকারী বা জাতীয়ভাবে এমন মেলার আয়োজন হয় না বিশ্বের আর কোথাও। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনার কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আমরা একত্রিত হচ্ছি একটি স্থানে। বিস্তার ঘটছে আমাদের সাহিত্যের। যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখিকা জেসমিন চৌধুরীও বইমেলায় অংশ নিতে আসছেন দেশে। টিকেট কাটা হয়ে গেছে। পাঠকদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতেই যুক্তরাজ্য থেকে ছুটে আসছেন তিনি। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, গতবছর বইমেলায় প্রথম বই প্রকাশের পর যে সাড়া পেয়েছি তাতে আমি অভিভূত! পাঠকদের কাছ থেকে সরাসরি পাঠপ্রতিক্রিয়া শোনা, কি-যে আনন্দের লেখক ছাড়া কেউই সেটা অনুধাবন করতে পারবে না। সন্তানের প্রশংসায় কেউ পঞ্চমুখ হলে আমরা যেমন আহ্লাদিত তেমনই সন্তানসম বইয়ের প্রশংসা আমাদের উদ্বেলিত করে। আর ভাষার মাসে, বইমেলায় দেশে এসে পরিচিতজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার যে আনন্দ সেটা আসলে আমরা যারা প্রবাসে থাকি তারা বলে বোঝাতে পারবো না। কবি আকাশলীনা বলেন, একুশে গ্রন্থমেলা আমার দেখা বইমেলাগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মেলা মানে জানি মেলনক্ষেত্র, এখানে মানুষে মানুষে দেখা, তাদের ভাব, কুশল বিনিময় তো আছেই। কাঁটাতারে ভেদাভেদ ছিঁড়ে আমি বা আমার মতো আরও অনেকে ছুটে আসি প্রতিবছর বইয়ের টানে, নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নিতে। আমার কখনো মনে হয়নি আমি ইন্ডিয়ান, আর আমার চারপাশের মানুষরা বাংলাদেশের। আমার এটাই মনে হয় আমার ভাষা এক। আমাদের একটা নদীর জল দুই দেশে বয়ে চলে। একটা কাঁটাতারের কি ক্ষমতা, আমাদের মতো সাহিত্য, প্রকৃতি, দেশপ্রেমী মানুষদের হৃদয়গুলোকে ভিন্ন করে দিতে!! যদি কেউ মনে করে থাকে, তারা কখনোই পারবে না। একুশের বইমেলায় অনেক আন্তরিকতা পেয়েছি, জানি আরও পাব। এ যে ফুরাবার নয়। এ অনন্ত, এ ভালোবাসা কখনোই অসত্য হবে না। সব সঞ্চিত হয়ে থাকবে আমার এই ছোট্ট হৃদয়টিতে। উচ্ছ্বাস ভরা প্রাণ, প্রত্যাশা অফুরান বইমেলা নিয়ে প্রকাশক-পাঠকের প্রত্যাশা যেমন অফুরান তেমনই লেখকের প্রত্যাশাও কোন অংশ কম নয়। প্রত্যেক লেখকই তাঁর সৃষ্টি কর্মের ব্যাপক প্রচার এবং বিপুলসংখ্যক পাঠকের হাতে সেটি পৌঁছাক সেই স্বপ্ন দেখেন। এবারের বইমেলা নিয়ে ক’জন লেখককের সঙ্গে কথা হয়। বইমেলা প্রসঙ্গে লেখকরা তাদের প্রত্যাশার কথা বলেছেন অকপটে। সকলের বক্তব্যেই এসেছে মানসম্মত বই প্রকাশের কথা। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসের মতে, পৃথক স্থানে মেলার আয়োজন অনেকটাই মেলবন্ধনের পথে অন্তরায়! পরিসর নিয়ে সমস্যার কারণে মেলা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রকাশকের সংখ্যাও বেড়েছে। ক্রমশই প্রত্যাশার প্রসারন ঘটছে। এ বছর বেশ কিছু বই ছাপা হচ্ছে যেগুলো নিয়েও পাঠকের প্রত্যাশা অনেক। তবে, আমি মনে করি অসঙ্গতিগুলো দূর করা উচিত। কারণ অসঙ্গতিগুলোই প্রত্যাশা পূরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই স্থানে মেলা আয়োজন করায় সমস্যা হয় পাঠকের। এমন অনেকে আছেন যারা একাডেমি চত্বর ঘুরে দেখার পর আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে চান না। ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া রাস্তা পারাপারের সমস্যা তো আছেই। আমরা চাই যুক্ততা। একসঙ্গে একই স্থানে মেলার আয়োজন। তবে আমি হতাশাবাদী নই, আমি আশাবাদী। আজ নয়তো কাল এই প্রত্যাশাটি পূরণ হবে। মেলার যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি তাড়িত করে সেটি হচ্ছে, প্রকাশনার ক্ষেত্রে বাছবিচার না করা। কিছু কিছু প্রকাশ আছেন যারা অর্থের বিনিময়ে বই করেন, যেগুলো আসলে পুস্তক নয়, জঞ্জাল। জঞ্জালমুক্ত বইমেলাই কাম্য। তাহলে বইমেলার উদ্দেশ্য স্বার্থক হবে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রত্যাশা করে কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল বলেন, বইমেলার সম্প্রসারণ ঘটলেও অনেকক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ধুলোবালুর সমস্যা ভোগান্তিতে ফেলে অনেককে। প্রতিবছরই এ নিয়ে বলা হয়, কিন্তু এর সমাধানে তেমন কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না! গেলবছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেশ কিছু স্থানে ইট বসানো হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, গেট সমস্যা। প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এক্ষেত্রে নজর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে মেলা থেকে যেন সহজেই বের হবার পথগুলো অতিক্রম করা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেইপথগুলো কোন দিকে সেটাও জানান দিতে হবে। কোথায় কোন স্টল তার ডিসপ্লে করাটাও জরুরী। তাহলে কাক্সিক্ষত স্টলগুলোতে সহজেই পৌঁছুতে পারবে পাঠক। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি জনবল সঙ্কটের কথা বলে নিজের দায় এড়াতে চায়? এত বড় একটি মেলা, যা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই আয়োজন অবশ্যই নিখুঁত হওয়া চাই। কথাসাহিত্যিক ঝর্ণা রহমান বলেন, বইমেলাকে ঘিরে সবারই কিছু প্রত্যাশা তো থাকেই! লেখক পাঠক প্রকাশক এক একজনের এক এক রকম প্রত্যাশা। সামগ্রিকভাবে প্রত্যাশার কিছু দিক আছে। এসবের মধ্যে নিরাপত্তাটাই বড়। হুমায়ুন আজাদের ওপর উগ্রবাদীদের আক্রমণের পর এই নিরাপত্তাহীনতা মেলাকে আতঙ্কিত করেছে। অভিজিৎকে হত্যার পর সে আতঙ্ক সাধারণের মনে স্থায়ী হয়ে উঠেছে। বিশেষ কোনো বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে কোনো প্রকাশকের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ, স্টলে আগুন দেয়া এসবও ঘটছে। তবে গত বছর বইমেলা অনেকটাই নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয়েছে। এবারও প্রত্যাশা, মেলার সামগ্রিক নিরাপত্তা বজায় থাকবে। সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নান্দনিক বিন্যাসেরও প্রত্যাশা রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ অনেক বড়। শুনলাম মেলার পরিসর এবার আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু এত বড় প্রাঙ্গণে কোথাও কোনো বসার ব্যবস্থা থাকে না, পানীয় জলের, চায়ের ব্যবস্থা থাকে না! মনে রাখতে হবে বইমেলা মানেই শুধু বিকিকিনির ব্যাপার না। এটি লেখক পাঠক ও সংস্কৃতিমনা মানুষজনের সম্মিলন স্থলও। মানুষ ঘুরবে, বসবে, গল্প করবে, আলাপ আলোচনা তর্কবিতর্ক গানবাজনা সবই করবে। তার সুযোগ রাখা দরকার। টয়লেট ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক তদারকিও প্রত্যাশা করি। যাতে প্রয়োজন মানুষ পানি সাবান টিসু আলো সবই পায়। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে বইমেলার উদ্বোধন করা হয়, কিন্তু মেলার সমাপ্তিটা বড় বৈশিষ্ট্যহীন থাকে। মেলার শেষ প্রহরটিকে কি আনুষ্ঠানিকতায় আনা যায় না? কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। একমাসব্যাপী বইমেলা সৃজনশীলতার প্রাঙ্গণ হয়ে উঠুক এটাই প্রত্যাশা। গবেষক শেখ ফজলে এলাহী বলেন, রংকরা পুতুলের মতো অসংখ্য বের হয় প্রতিবছর বইমেলায়। সুন্দর কাভার, সুন্দর প্রচ্ছদের ভেতরে আসলে কিছুই থাকে না। এগুলোকে কোনভাবেই বই বলা যায় না, যাবে না। অনেক প্রকাশক টাকার বিনিময়ে এটি করে থাকেন। সেইসব প্রকাশকদের যেমন কোন যাচাই বাছাইয়ের বালাই নেই। তেমনই নেই কোনও সম্পাদক। শুধু অর্থনৈতিক কারণে বই বের করেই নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন তারা। তিনি বলেন, ভালোই যদি না হয় তাহলে এত বই বের করার কি দরকার? বাংলাদেশের বইয়ের দাম অধিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, হার্ড কাভারেই কেন সব বই বাঁধাই করতে হবে? পাঠকরা যাতে কমমূল্যে বই কিনতে পারে সেজন্য বুককাভারে, নিউজপ্রিন্টে বই প্রকাশ করা যেতে পারে। এমনকি উভয়ভাবেও করা যেতে পারে। তাহলে পাঠক স্বল্পমূল্যে পছন্দসই অনেক বই কিনতে পারবে। লেখক, গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী বলেন, একুশে বইমেলাকে আমাদের অন্যতম উৎসবও বলা চলে। তাই প্রত্যাশা করি, এই উৎসব যেন একদিন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বই জ্ঞানের বাহক। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত নিজে বই কেনা এবং অন্যকে তা উপহার হিসেবে দেয়া। লেখক হিসেবে একটি কথা বলতে চাই, প্রকাশকদের কাছ থেকে লেখকরা যেন তাঁদের ন্যায্য হিস্যা পান তার ব্যবস্থা করা দরকার। প্রকাশকদের বাণিজ্যিক মনোভাবের পরিবর্তে পেশাদারী মনোভাব থাকা প্রয়োজন। বইমেলায় স্টল বিতরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশকের প্রোফাইল বা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে যেন বিচার না করা হয়। অনেক প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম হলেও সেগুলোর গুণগতমান অনেক ভালো। আবার বিপরীতটিও আছে। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সরিয়ে যোগাযোগ, পরিবহন, নিরাপত্তাসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি বিকল্প স্থায়ী জায়গার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। এ বিষয়ে সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনাসহ প্রকাশনা শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। সে বিবেচনায় শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, প্রাত্যহিক জীবনেও তার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা বলেন, বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা তো সারাবাছর ধরেই থাকে। মনে করি, গতবারের ভুলত্রুটি সঙ্কট কাটিয়ে এবার বইমেলা আমাদের প্রত্যাশার আরও কাছাকাছি যাবে। তা যদিও খুব দ্রুত ঘটার নয়। তবু আয়তন স্টল বিন্যাসÑ এইসব দিকে গত কয়েক বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও সেখানেও কোনো কোনো অব্যবস্থাপনার কথা প্রচারমাধ্যমে শুনতে পাই। তবে সবচেয়ে যেটা দরকার, ভালো বইয়ের প্রচারের ব্যবস্থা করা। এমনিতেই আমাদের বইমেলায় বই প্রকাশিত হয় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। তার ভিতরে ভালো বইয়ের সংখ্যা কম। কিন্তু বইমেলার সময়ে প্রচুর কম মানসম্পন্ন বইয়ের খবর প্রচারিত হয় প্রচার মাধ্যমে। পাঠক না বুঝে তা কেনেন। আর ভালো বইটি থেকে যায় প্রচারের বাইরে। এর ফলে পাঠকেরও ধারণা হয় দেশে ভালো বই মনে হয় তেমন বের হয় না। তিনি বলেন, পরিবেশ বিষয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। এটুকু বুঝি, মানুষের চলাচল যেন অনায়াসসাধ্য হয়। বৃষ্টি হলে (যদি হয়) যে পাঠকের অসুবিধা না হয়। বইয়ের প্রচারের জন্য যে মাইক বাজে, তা কখনও কখনও কথা বলা, আলাপে আড্ডায় বিঘœ ঘটায়। এমন ব্যবস্থা রাখা উচিত যাতে মাইকের আওয়াজ দরকারমতো কমানো বাড়ানো যায়। মুক্তধারার অনন্য উদ্যোগ, এক স্টলে প্রবাসীদের বই! বইমেলায় বহির্বিশ্বে বসবাসরত বাঙালী লেখকদের জন্য অনন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মুক্তধারা। এ বছর প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কের এই প্রতিষ্ঠানটি একুশের বইমেলায় দিয়েছে নিজস্ব স্টল। ‘বহির্বিশ্বে বাঙালী লেখক,’ এই শিরোনামে শুধুমাত্র অভিবাসী বাঙালী লেখকদের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বই দিয়ে সাজানো হয়েছে এই স্টল। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা জানান, বিশ্বের তিরিশটির মতো দেশে অবস্থানরত লেখকদের বই আমরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। এইসব বই থেকে নির্বাচিত একগুচ্ছ বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে সাজানো হয়েছে স্টলের বহিরাবরণ। স্টলের ভেতরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মুক্তধারার উদ্যোগে ২০১৭ সালে স্থাপিত একুশের স্মৃতিস্তম্ভ। তিনি বলেন, অভিবাসী সকল লেখকের বই বাংলাদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই আমাদের এই উদ্যোগ। দেশের বাইরে থাকলেও বাঙালী লেখকরা সবাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূলধারার অঙ্গিভূত, নিজেদের সাহিত্য কর্মের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তারা প্রতিদিন সমৃদ্ধ করে চলেছেন। এই স্টলের মাধ্যমে সেই কথাটি আমরা বাংলাদেশের পাঠকদের অবগত করতে চাই। প্রকাশকদের প্রধান দাবি, নিরাপত্তায় আস্থা একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট। তাই বইমেলাকে জমজমাট করতে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই। প্রকাশরা জানিয়েছেন, আক্ষরিক নয় এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে যাতে আস্থা তৈরি হয় পাঠকদের। তখন আয়োজন স্বার্থক হবে। মেলা নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে নিরাপত্তাটাকেই প্রধান্য দিলেন উৎস প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী মোস্তফা সেলিম। তিনি বলেন, মেলার সঙ্গে তো নানা পক্ষ জড়িয়ে আছেন। তবে, সবচেয়ে সরাসরি যে পক্ষ এখানে জড়িত, তারা হচ্ছেন প্রকাশক। একজন প্রকাশক এ ছাড়াও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার চাওয়া একটু আলাদা। আমাদের একুশে গ্রন্থমেলা নিছক একটি বই বিপণনের মেলা নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনাবাহী একটি বিশাল আয়োজন। এখানে এসে একজন মানুষ অর্জন করেন যেমন আনন্দ, তেমনি লাভ করেন বাঙালী হবার দীক্ষা। তাই, আমার প্রত্যাশা, এটি যেনো প্রকৃত পক্ষেই একটি চেতনার মেলা হয়। আয়োজনে থাকে সেই আন্তরিকতা। এবারের মেলাটি যদি সে লক্ষ্যে লেখক, পাঠক, প্রকাশককে অনুপ্রাণিত করতে পারে তাহলে আমি খুশি হবো। বাতিঘরের পরিচালক দীপঙ্কর দাশ বলেন, বইমেলার পরিবেশ বিশেষ করে নিরাপত্তা ইস্যুতে পাঠকদের মনে আস্থা তৈরি করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি। কারণ নিরাপত্তাহীনতায় ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে সকল আয়োজন। তাই এই দিকটায় নজর দিতে হবে সবচাইতে বেশি।
×