ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের বাইরে দেশকে তুলে ধরছেন মুকুল হোসেন

শেক্সপিয়ারের নাটকে বাংলার লোকসুর, নজরুলের গানে অপেরা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শেক্সপিয়ারের নাটকে বাংলার লোকসুর, নজরুলের গানে অপেরা

মোরসালিন মিজান ॥ শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট।’ ইংরেজী ভাষার নাটক। যুক্তরাজ্যে মঞ্চস্থ হচ্ছে। অভিনেতা অভিনেত্রীও সেই দেশের। অথচ চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে যেতেই দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশ। কানে ভেসে আসছে লোকজ সুর। নাটকের বিভিন্ন পর্যায়ে ঐতিহ্যবাহী পালাগানের ব্যবহার করা হচ্ছে। চলছে লাঠিখেলা। স্বতন্ত্র দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ দর্শক সারিতে বসে তা উপভোগ করছেন। বারবার দেখা নাটক চোখ কচলে আবার দেখছেন। তবে শুধু শেক্সপিয়ারের নাটকে নয়, নতুন নতুন প্রযোজনায় ইংরেজীর সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সংযোগ ঘটানো হচ্ছে। আর দেশের বাইরে দেশকে এমন সচেতনভাবে তুলে ধরার মূল কাজটি যিনি করছেন তিনি মুকুল হোসেন। প্রবাসী নাট্য নির্দেশক। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানকার নাট্যসংগঠন মুকুল এ্যান্ড গেটো টাইগার্স-এর কর্ণধার তিনি। ১৯৯৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে তার নির্দেশিত ২৫টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। শেক্সপিয়ার ও আন্তন চেকভের নাটক আছে। আছে মৌলিক প্রযোজনাও। নিভৃতচারী নাট্যকার মাঝে মাঝেই দেশে আসেন। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন তিনি। টুকরো আলাপ হয়েছিল আগেই। এরপর গত কয়েকদিন আগে সান্ধ্য আড্ডা। নাতিদীর্ঘ আলোচনা। শেক্সপিয়ারের দেশে নাটকের চর্চা, সেখানে একজন বাঙালী নির্দেশকের স্বপ্ন, নিরীক্ষা, চ্যালেঞ্জসহ বাংলা নাটকের বিভিন্ন দিক উঠে আসে আলোচনায়। চমকপ্রদ তথ্যটি আগে দেয়া যাক। শুনে অনেকেই চোখ কপালে তুলবেন, মুকুল হোসেন চিকিৎসা শাস্ত্রের লোক। ভালভাবে পাস দিয়েই বিলেতে যান। তার পর হঠাৎ করেই বদলে যায় পথ। হ্যাঁ, নাটকীয়ভাবেই নাটকে প্রবেশ। তার ভাষায়Ñ ‘অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে নাটক-থিয়েটারে ঢুকে পড়েছিলাম।’ তবে এই ঢুকে পড়া যে অনুপ্রবেশ ছিল না তা এখন প্রমাণিত। বর্তমানে বছরে চার থেকে পাঁচটি নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। শেক্সপিয়ারের দেশ। শুরুটা করেছিলেন শেক্সপিয়ারের নাটক দিয়েই। ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’র মতো নাটকের নির্দেশক তিনি। সারা পৃথিবীতে অনেকেই নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে তিনি একটা দারুণ চমক নিয়ে আসেন। কালজয়ী নাটকে যোগ করেন বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির উপাদান। শেক্সপিয়ারের নাটকে পালা গানের ফর্ম ব্যবহার করেন। কীভাবে সেটা? জানতে চাইলে মুকুল হোসেন বলেন, ‘নাটকের শুরুতে যে বন্দনা, সেখানে বাংলা লোকগান ব্যবহার করি আমি। বাংলা কথা ও সুরে কী বলা হলো, ন্যারেশনের সময় তা ইংরেজীতে বলে দেয়া হয়। চরিত্রগুলোর এন্ট্রি ও এক্সিট হয় পালা গানের সুরে। গানগুলো লাইভ গাওয়া হয়।’ মূল নাটকে রোমিওর হাতে ছুরি উঠেছিল। সে কথা সবার জানা। মুকুল বলেন, ‘আমি ছুরির পরিবর্তে বাঁশের লাঠি তুলে দিয়েছি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলাকে যুক্ত করেছি নাটকের সঙ্গে। ‘জুলিয়াস সিজার’ এবং ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ নাটকেও আছে কিছু নিরীক্ষা। মুকুল হোসেনের মৌলিক নাটকগুলোতে আরও বেশি পাওয়া যায় দেশকে। দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই হয়ত দেশভাগ হয়ে উঠে তার নাটকের বিষয়। ভারত ভাগের ইতিহাস মঞ্চে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে নির্দেশক বলেন, ‘নাটকের বেঙ্গল পার্টে কিছু শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। নজরুলের গান আছে। পাঞ্জাব অংশে আছে পাঞ্জাবী গান।’ দেশভাগ কেন হলো? কতটা অনিবার্য ছিল? আসলেই কি এই ভাগাভাগি এড়ানো যেত না? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এই নাটকে খোঁজা হয়েছে বলে জানান তিনি। মানবতার কবি নজরুলকে মঞ্চের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন মুকুল হোসেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য কবিকে ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময়ের গল্প নিয়ে মঞ্চ নাটক ‘নজরুল ইন ভিয়েনা।’ এতে নজরুল সঙ্গীতের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে ওয়েস্টার্ন অপেরার ফর্ম। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নজরুলের গান দিয়ে ওয়েস্টার্ন কম্পোজারের সঙ্গে বসেছি। তাকে বলেছি, গানের কথা ঠিক থাকবে। সুর ঠিক থাকবে। একজন শিল্পী নজরুলের গান গাইবেন। একই গানে অপেরা ফর্মটি ব্যবহার করবেন আরেক শিল্পী। সেভাবেই মিউজিক কম্পোজ করা হয়েছে।’ নিজের ভেতরে বাঙালীত্বের বোধ তীব্র। পাশাপাশি নিজেকে তিনি একজন বিশ্বনাগরিক ভাবতে ভালবাসেন। সে কথা জানিয়ে বলেন, ‘গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজ বলে কিছু নেই। এ ধরনের নাটকের মাধ্যমে আমি কয়েকটা ভাষা কালচার ও বিশ্বাসকে একজায়গায় আনার চেষ্টা করি। এর বাইরে নাটকের তো নিজের একটি ভাষা আছে। এর মধ্য দিয়ে সবার কাছে পৌঁছতে চাই। কতটুকু কাছে আসা যায়, সেই চেষ্টা করি।’ এ পর্যায়ে আসে অভিনেতা অভিনেত্রী প্রসঙ্গ। সবাই কি বিদেশী? বাংলাদেশের নাচ গান তারা কতোটা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম? জবাবে মুকুল হোসেন বিস্তারিত তুলে ধরেন। বলেন, ‘লন্ডনে একটি নাটক মঞ্চে আনার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অভিনয় শিল্পী সংগ্রহ করা চাই। বাংলাদেশের দুই একজন ভাল শিল্পী আমি পেয়েছি। তারা নিজ দেশের ভাষা সঙ্গীত সংস্কৃতিকে সুন্দর তুলে ধরেন। বাকিরা সবাই বিভিন্ন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশের ভাষা সঙ্গীত সংস্কৃতি শিখে নিয়ে ওরা পারফর্ম করে। প্রথমে নাটকটি ইন্ডাস্ট্রি পিপোলকে ডেকে দেখানো হয়। ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের প্রেজেন্টেশন নিয়ে যাই আমরা। তার পর ফিডব্যাক চাই। তাদের কাছ থেকে পাস মার্ক পেলেই সেটা মঞ্চে ওঠে। মঞ্চে আনতে রাজি হয় তারা।’ ইউরোপের নাট্য চর্চার নানা দিকও উঠে আসে আলোচনায়। বাঙালী নাট্যজন বলেন, ‘সারা ইউরোপেই নাটকের বিশাল অডিয়েন্স। ওখানে নাটক ওদের পার্ট অফ লাইফ। পার্ট অফ এন্টারটেইনমেন্ট। ওদের টেকনোলজিও খুব এডভান্সড। প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। বহু ধরনের কাজ। একটু কমার্শিয়াল থিয়েটার একটা আছে। মিউজিক্যাল থিয়েটারগুলোর কথা বলছি। এগুলো ভীষণ পপুলার। আবার গভীরতর বোধ থেকেও অনেক কাজ হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখান থেকে যাত্রাটা একদমই ভিন্ন।’ লন্ডনে থাকলেও, বছরে অন্তত একবার নিজ দেশে আসেন মুকুল হোসেন। নীরবেই কাজ করেন। তিনি জানান, বিভিন্ন সময় দেশে তার নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। ২০১১ সালে ঢাকায় মঞ্চস্থ হয় শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার।’ নাটকের সবগুলো চরিত্রে নারীরা অভিনয় করেন। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ হয় আরেক উল্লেখযোগ্য নাটক ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম।’ বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক খুব যতœ করে দেখেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মঞ্চে অসাধারণ সব নাটক হয়। বিশ্বমানের নাটক হয়। কিন্তু এসব নাটক বাইরের দেশগুলোতে একদমই যায় না। বাংলাদেশে শেক্সপিয়ারের বহু নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। বিদেশী অন্য লেখকদের গল্প নিয়ে কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের গল্পগুলো কেন ওইসব দেশে যাবে না?’ এ ব্যাপারে নাটকের বিশিষ্টজনদের উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। মুকুল হোসেন বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতে গিয়ে নাটকের কাজ করেন। পশ্চিমবঙ্গে বেশ পরিচিতি। তিনি জানান, কলকাতায় অনেকের সঙ্গেই তার কাজ করা হয়েছে। বর্তমানে কাজ করছেন ঊষা গাঙ্গুলীর সঙ্গে। একটি জার্মান নাটকের কাজ করছেন তারা। জানান, দিল্লীতে অনুষ্ঠেয় থিয়েটার অলম্পিকেও যাবে তার ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট।’ এসবের বাইরে দেশ বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিষয়ে পড়ান মুকুল হোসেন। এতো গেল বর্তমান সময়ের সংলাপ। পেছনের আরও কিছু গল্প না জানা হলে মুকুল হোসেনকে পুরোপুরি জানা হবে না। চিকিৎসা বিদ্যা ছেড়ে দিয়ে নাটক। কীভাবে সম্ভব হলো? কেমন ছিল যুদ্ধটা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ভাল বলতে পারব না। নাটকে আমার কোন প্রথাগত শিক্ষাও ছিল না। এ অবস্থায় লন্ডনে গিয়েছিলাম। প্রথম বছরই একটি বিজ্ঞাপন দেখে কেন যেন আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। অডিশন দিয়ে বেশ প্রতিষ্ঠিত একটি নাটকের দলে অভিনয়ের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম। তার মানে অভিনয় দিয়ে শুরু? ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেন মুকুল। বলেন, ‘তবে অভিনয়ে বেশি সময় দেয়া হয়নি। নির্দেশনার নেশা পেয়ে বসেছিল। আমি একজন স্টোরি টেলার। নিজে তো পারি না। এ্যাক্টরসদের মাধ্যমে, সেট লাইটের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করি।’ নির্দেশনা গুরু দায়িত্ব। এর জন্য কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নিজের জার্নিটা আরও একটু পরিষ্কার করেন তিনি। বলেন, ‘১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত একটা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কাজ করি আমি। ওটা ছিল লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব থিয়েটারস। ওদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও ম্যানেজমেন্টটা সম্পর্কে জানার শেখার সুযোগ হয়। ১৯৯৩ সালের দিকে মোটামুটি সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলি যে, নাটক করেই বাঁচব। তখন টুকটাক কাজ করছি। কমিউনিটি থিয়েটার, ইয়োথ থিয়েটারÑ এইসব। ২০০৫ সালে নেয়া হয় পার্মানেন্ট সিদ্ধান্ত। ঠিক করি নাটক ছাড়া অন্য কিছু করব না। নিজেকে আরও একটু প্রস্তুত করে নিতে বছরতিনেক এ্যাক্টরস ট্রেনিং নিই। সে সময় খুব অল্প সময়ের জন্য স্টেজে কাজ করেছি। পরে থিয়েটার ডিরেক্টিংয়ের ওপর মাস্টার্স করি। এর বাইরে বিলেতে থাকার সুবাধে প্রচুর নাটক দেখেছি। বিভিন্ন দেশের নাটক। অসংখ্য ফর্ম। সেগুলো থেকে একটু একটু করে এনরিচ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘সময়ের বাস্তবতার চেয়েও বড় ছিল নিজের প্যাশন। নিজের যে গল্পটা বলার প্রয়োজন মনে করেছি, বলেছি। এই যেমন, প্রথম নাটকটি ছিল ফ্যান্টাসি। ওটাই বলতে পারেন প্রথম ফুল স্টেজ। তিনি যোগ করেন, পার্সনালি মেইন স্ট্রিম আর এ্যামেচার এই টার্মগুলোতে খুব একটা বিশ্বাস করি না আমি।’ এমন কথায় আবারও বোঝা যায়, প্রচলিত ধ্যান, পুরনো চিন্তা ছুড়ে ফেলে নতুন এক নাট্যভাষা গড়তে চান মুকুল হোসেন। নিজ দেশকে নিয়ে এমন এগিয়ে চলা অব্যাহত থাকুক।
×