ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু আজ, উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু আজ, উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

মোরসালিন মিজান ॥ ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরব নিয়ে শুরু হচ্ছে- অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা, বিকাশ, বাঙালী সংস্কৃতির বহমান উদার অসাম্প্রদায়িক ধারায় অনন্য সংযোজন বইমেলা আজ বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি এর আয়োজক। মাসব্যাপী মেলায় অংশ নেবে মূল ধারার প্রায় সকল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হয়ে মেলা চলবে শেষ দিন পর্যন্ত। বইয়ের প্রদর্শনী বেচাকেনার এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন সারা বিশ্বে বিরল। সকল বাঙালীর আবেগ ভালবাসার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ বইমেলা একইসঙ্গে প্রাণের মেলা হিসেবে খ্যাত। শুধু বইকে কেন্দ্র করা হলেও, কালক্রমে এটি হয়ে উঠেছে বঙ্গ সংস্কৃতির বৃহৎ উৎসব। বিশাল আয়োজন। বড় প্রস্তুতি। শেষ হচ্ছে হচ্ছে করেও হয় না। এ অবস্থায় বুধবার বিকেলে মেলার প্রস্তুতি দেখতে বাংলা একাডেমিতে আসেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখেন তিনি। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলা চলে। টুকটাক কাজ বাকি আছে। সেগুলোও মেলা উদ্বোধনের আগেই শেষ হয়ে যাবে। এবারও প্রচুর বই আসবে মেলায়। তবে বইয়ের মান নিয়ে যে প্রশ্ন, রয়েই গেছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বইমেলায় বই প্রকাশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু মান নিয়ে অনেকেই ভাবছেন না। আমরা যদি বইয়ের মানই বৃদ্ধি করতে না পারি, তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা মেলা আয়োজন করি, সেটি ব্যাহত হবে। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এবার ভাল মানের বইয়ের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করছি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল বাঙালী। রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বারের তাজা রক্ত গড়েছিল নতুন ইতিহাস। তাদের রক্তে নতুন প্রাণ পায় আমরি বাংলা ভাষা। অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। অনন্য সাধারণ সূচনা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের বটতলায় চট পেতে বসেছিলেন স্বপ্নবাজ এই প্রকাশক। মাত্র ৩২টি বই। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে একাই উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন চিত্তরঞ্জন। যতদূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। কোন কোন সূত্র মতে, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। বর্তমানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। এরই মাঝে চলতি বছরের আয়োজনের সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চ। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য বর্ধমান হাউসের সামনে বিশাল এই মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানেই আজ বিকেল ৩টায় মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপস্থিত থাকবেন কয়েকজন বিদেশী কবি ও সাহিত্যিক। যুক্তরাজ্যের এগনিস মিডোস, ক্যামেরুনের ড. জয়েস অ্যাসউনটেনটেঙ, মিশরের ইব্রাহিম এলমাসরি ও সুইডেনের অরনে জনসন বাংলা সাহিত্য ও বইমেলা নিয়ে তাদের অনুভূূতির কথা জানাবেন। একই অনুষ্ঠানে প্রদান করা হবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। পরে মেলা ঘুরে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে মেলা। এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় আয়োজন করা হচ্ছে মেলা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মেলাকে ১২টি চত্বরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। মোট ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১৯টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমিসহ ২৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১৫,৫৩৬ বর্গফুট আয়তনের ২৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯২ প্রতিষ্ঠানকে ১৩৬টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৮৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ৬টি পথ। টিএসসি ও দোয়েল চত্বর সংলগ্ন এলাকায় পথগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার জন্য রাখা হয়েছে তিনটি পথ। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের প্রবেশের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হবে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে মেলা। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ২১ ফেব্রুয়ারি মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হবে সকাল ৮টায়। চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এবারের গ্রন্থমেলায় পাওয়া যাবে বাংলা একাডেমির নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১৪১টি নতুন বই। এর বাইরে পুরনো গুরুত্বপূর্ণ সব বই পাওয়া যাবে মেলায়। মেলার দুই অংশ থেকেই সংগ্রহ করা যাবে বাংলা একাডেমির বই। একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের বিপুল সংগ্রহ তুলে ধরতে বেশ কয়েকটি প্যাভিলিয়ন ও স্টল সাজানো হচ্ছে। মেলায় থাকবে একটি প্যাভিলিয়ন ও ৪ ইউনিটের ২টি স্টল। শুধু শিশুকিশোরদের উপযোগী বই থাকবে একটি স্টলে। একাডেমির সাহিত্য মাসিক ‘উত্তরাধিকার’ পাওয়া যাবে একটি স্টলে। বহেরা তলায় সাজানো হচ্ছে লিটলম্যাগ কর্নার। এবার ১৩৬টি লিটল ম্যাগাজিনকে জায়গা দেয়া হয়েছে এখানে। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। শিশু কিশোরদের জন্য মেলায় থাকছে আলাদা আয়োজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি অংশকে সাজানো হচ্ছে শিশুচত্বর হিসেবে। এই কর্নারকে শিশুকিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। থাকবে বিশেষ ‘শিশুপ্রহর’। শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। মেলা মঞ্চে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট বাঙালী মনীষীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ। বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ-টু-আই কর্তৃপক্ষ গ্রন্থমেলায় তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ খবরাখবর এবং মেলার মূল মঞ্চের সেমিনার প্রচারের ব্যবস্থা করবে। মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। গ্রন্থমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলায় আড়াই শ’ ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা সচল থাকবে। সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ পুলিশ। র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বিভিন্ন দ্বায়িত্ব পালন করবে।
×