ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতায়িত নারীদের উন্নত জীবনমান শীর্ষক প্রকল্পের আলোচনা

দারিদ্র্যের চাহিদামাফিক প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দারিদ্র্যের চাহিদামাফিক প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দারিদ্র্যবিমোচন সংক্রান্ত বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলোতে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেছেন, বিদেশী সহযোগীরা, যাদের আমরা দাতা বলি, তাদের অনেকেই দারিদ্র্যবিমোচনের নির্দিষ্ট কিছু ধ্যান-ধারণা নিয়ে আসেন; বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেগুলোর অধিকাংশই কার্যকর হয় না। প্রকল্প প্রণয়নের সময় ওই সব ধ্যান-ধারণার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। এতে দরিদ্র মানুষের সত্যিকার প্রয়োজন ও চাহিদা উপেক্ষিত হয়। প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, দারিদ্র্যবিমোচন ও টেকসই উন্নয়নে যারা আসলেই সহায়তা করতে চান, তাদের স্থানীয় মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন ও পরিপ্রেক্ষিত ধারণ করতে হবে। শুধু ক্ষুদ্রঋণ কিংবা একই ধরনের প্রকল্প দিয়ে টেকসই দারিদ্র্যবিমোচন হয় না। বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টার মিলনায়তনে ক্ষমতায়িত নারীদের উন্নত জীবনমান (জেইডব্লিউইএল-জুয়েল) শীর্ষক প্রকল্পের আলোচনা ও মূল দল (কোর গ্রুপ) গঠনের কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রেড ক্রাফট এক্সচেঞ্জ ও স্থানীয় উলসি সৃজনী সংঘ যৌথভাবে কর্মশালার আয়োজন করে। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ট্রেড ক্রাফট এক্সচেঞ্জের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর শাহেদ ফেরদৌস। প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন উলসি সৃজনী সংঘের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার আজিজুল হক মণি। কর্মশালায় প্রকল্পের আওতায় নারীদের নিয়ে গঠিত কৃষি পণ্য উৎপাদক এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধরা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগী ফরিদপুর ও যশোরের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারাও বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় জানানো হয়, প্রকল্পের আওতায় ফরিদপুর সদর উপেজলা, ভাঙ্গা ও বোয়ালমারী এবং যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ৪ হাজার ৩২০ জন দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীরা একত্র হয়ে ১৬০টি দল ও ৫টি কৃষি পণ্য উৎপাদক এ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছেন। এসব দলের সদস্যদের সরাসরি কোন অর্থসাহায্য দেয়া হয়নি। বরং সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উৎসাহ ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারী-বেসরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সদস্যরা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের পালনের প্রশিক্ষণ, ফসল চাষ, কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি, মুরগির ভ্যাকসিন দেয়া, সবজি উৎপাদন, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা, টেইলারিং ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২৭ জনের প্রতিটি দল মাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় জমা করে ও সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে। বিদেশী সাহায্যপুষ্ট চার বছর মেয়াদী ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের এপ্রিলে। বর্তমানে এসব নারীর সম্মিলিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সদস্য পর্যায়ে বিনিয়োগ রয়েছে ৮২ লাখ টাকা, যাতে লাভের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ টাকা। কর্মশালায় উপস্থিত নারীরা জানালেন প্রকল্পের কারণে তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ফরিদপুরের ময়না আক্তার বলেন, আমরা নিজেদের উদ্যোগে সঞ্চয় করি। কোন এনজিওর কাছে যাইতে হয় নাই। সঞ্চয় থাইক্যা ৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ নিয়া আমি হাঁস-মুরগি পালা শুরু করি। সরকারী অফিসারদের কাছ থাইক্যা ভ্যাকসিন দেয়ার প্রশিক্ষণ নিছি। এতে হাঁস-মুরগির সহজে কোন অসুখ হয় না। এখন ডিম বেইচ্যাই আমার অনেক টাকা ইনকাম হয়। আমাদের স্বামীরা আগে বাজারেই যাইতে দিত না। আইজ আমরা ঢাকায় আসছি। এখন স্বামীরাও আমাদের পাশে দাঁড়াইছে। মাবিয়া আক্তার বলেন, আমার সংসারে অন্ধকার ছিল। এখন আলোর দেখা পাইসি। প্রশিক্ষণ নিয়া আমি আমার এলাকায় মুরগির ভ্যাকসিন দেয়ার কাম করি। আমার নিজের ১২৭টা মুরগি আছে। খালেদা আক্তার বলেন, ভার্মি কম্পোস্ট, ছাগল পালন ও মুদি দোকান থেকে এখন আমার মাসিক আয় ১২-১৩ হাজার টাকা। আরিফা বলেন, আমি মাটি পরীক্ষার ট্রেনিং করছি। এখন এলাকায় আমি মাটি পরীক্ষা করে ফসল চাষের পরামর্শ দেই। আগে সরকারী অফিসারদের কাউরে চিনতাম না। এখন সবাই আমারে চেনে। সংসারের অনেক খরচের জন্য স্বামীর কাছে আর হাত পাততে হয় না। আগামী ২০১৯ সালের মার্চে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, মেয়াদ পরবর্তী সময়েও এসব দলের সদস্যরা যাতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচলান ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য তিনি বাজার যাচাই করে পণ্য উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও প্রান্তিক উৎপাদকদের নিজস্ব সংগঠন তৈরির ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন হলো মূল কথা। এজন্য অর্থায়নের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ ও মানবিক গুণাবলী চর্চার সমন্বয়ও ঘটাতে হবে।
×