ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপমানে আত্মহত্যা

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অপমানে আত্মহত্যা

হবিগঞ্জে একটি গ্রামের ৪র্থ শ্রেণীর মাদ্রাসাছাত্রী স্বপ্না বেগমের আত্মহত্যার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পরে বিয়ের জন্য চাপ দিলেও অস্বীকার করায় এলাকার বখাটে ব্যর্থ প্রেমিক নয়ন আহমেদ শান্ত ও সহযোগীরা জোরপূর্বক তুলে আনে দিনমজুরের কন্যা স্বপ্না বেগমকে। স্থানীয় একটি দোকানে আটক রেখে চলতে থাকে বিয়ের প্রস্তুতি ও কেনাকাটা। শেষ পর্যন্ত দোকানের মালিকের সহায়তায় স্বপ্না মুক্তি পেলে বসে গ্রাম্য সালিশ। সেখানেও নানা বিদ্রƒপ ও রসাত্মক আলোচনার মাধ্যমে তিরস্কার করা হয় তাকে। এতে সামাজিকভাবে অপমানসহ হেয় করা ও লোকলজ্জার ভয়ে ঘরে ফিরে আত্মহত্যা করে স্বপ্না বেগম। ঘটনার জের ধরে বখাটে ব্যর্থ প্রেমিক শান্ত ও সহযোগীদের গ্রেফতার না করায় থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। এটিকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি কেবল বিয়ে বা ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। অথবা ধর্ষিতা পরিবার সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছে। তদুপরি তথাকথিত ফতোয়া বা সামাজিক বিচারের রায়ে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ধর্ষিতাকে। উৎপীড়িত পরিবারটিকে করা হচ্ছে একঘরে। কোথাও যদি ধর্ষকের শাস্তি হয়ও, তবে তা নামমাত্র। অথচ অসহায় ধর্ষিত মেয়েটিকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় কলঙ্কের বোঝা। আরও যা ট্র্যাজেডি, তা হলো, ধর্ষণ, নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা অনেক সময় আসে না গণমাধ্যমে। পরিবারের মান-সম্মান, মেয়েটির সম্ভ্রম, সামাজিকতা ও লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যাওয়া হয় অথবা দেয়া হয় ধামাচাপা। শেষ পর্যন্ত সামাজিক বাধাবিঘœ পেরিয়ে যেসব ঘটনা ঠাঁই পায় গণমাধ্যমে, তাতে দেখা যায়, গত বছর শিশুসহ সব ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। তবে সর্বাধিক আলোচিত ছিল সোহাগী জাহান তনুর ঘটনা। ২৩ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন সংরক্ষিত এলাকায় ঝোপের মধ্যে পাওয়া যায় তনুর লাশ। অবশ্য এর বাইরেও সার্বিকভাবে বেড়েছে নারী নির্যাতন-নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান এমনকি যৌতুক না পেয়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর জিহ্বা ও পায়ের রগ কেটে দেয়ার মতো ঘটনা। নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে বাংলাদেশের নারী সমাজ বিশ্বে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে এদিক থেকে। অবশ্য নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে দেশে যথেষ্ট ভাল আইন রয়েছে। তবে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ সীমিত ও সীমাবদ্ধ। অবশ্য এর জন্য নিম্ন আদালতসহ থানা-পুলিশও কম দায়ী নয় কোন অংশে। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে বিস্তর। বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা সীমিত। আর সেজন্য শুধু আইন থাকলেই হবে না, পাশাপাশি সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী-পুরুষের সমঅধিকারের বিষয়টি সমাজে এখনও অগ্রহণযোগ্য। সে অবস্থায় সহিংসতার শিকার নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় অভিগম্যতা বাড়ানো না গেলে সেটার বাস্তবায়ন কঠিন। সরকার সে ক্ষেত্রে নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে আন্তরিক ও সচেষ্ট হবে বলেই প্রত্যাশা। আমরা হবিগঞ্জের হতভাগিনী আত্মঘাতী স্বপ্না বেগমের ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্তসহ দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবি জানাই।
×