ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

থাই রাজনীতির চালচিত্র

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

থাই রাজনীতির চালচিত্র

সাবেক প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০০৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন সেই থাকসিন সিনাওয়াত্রার এখনও যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইসান এলাকার লোকেরা তো থাকসিন ও তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা অন্ধ অনুসারী। বলাবাহুল্য, থাইল্যান্ডের প্রায় ৭ কোটি লোকের এক-তৃতীয়াংশ সে অঞ্চলেই বাস করে। থাইল্যান্ডের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভোটারদের বদৌলতেই সিনাওয়াত্রার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত দলগুলো ২০০১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। তাদের সমর্থকরা নিজেদের লাল শার্ট বলে থাকে। এরাই সিনাওয়াত্রাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংগঠন ফিউ থাই পার্টি (পিটি)র মূল শক্তি। কিন্তু ইদানীং সেখানকার লোকজনদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে দোদুল্যমানতা দেখা দিয়েছে। সামরিক সরকারের প্রতি জনগণের একাংশের অপ্রত্যাশিত সমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন জুটামান কামসোমক্সি নামে কৃষক পরিবারের এক বধূ মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা দলের পক্ষে নয়, নীতির পক্ষে ভোট দেই। আমরা নির্বোধ নই। আমরা ফেসবুকে খবর দেখি।’ ইসানের কৃষকদের মধ্যে এবার অদ্ভূত রকমের দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামরিক সরকার তিন-তিনবার বিলম্বিত রাখা পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী নবেম্বর মাসে আয়োজন করলে তারা কিভাবে ভোট দেবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। ইসানের বিশাল তল্লাটজুড়ে ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। কাসাভা, আখ ও অন্যান্য ফসলও আবাদ হয়। তবে উৎপাদিত পণ্যের দাম নিয়ে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। কারণ প্রত্যাশিত দাম তারা পাচ্ছে না। ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়টায় কৃষি পণ্যের ভাল দাম পাওয়া গিয়েছিল। তারপর থেকে দাম পড়ে গেছে। সিনাওয়াত্রাদের জনপ্রিয়তা ছিল তাদের লোক বহুজনবাদী নীতির ফল। ইসানের মানুষের ভালবাসা বেশ দাম দিয়েই কিনে নিয়েছিল তারা। চালের ভর্তুকির কথাই ধরা যাক। থাকসিন কৃষকদের ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার আমলে সেই ভর্তুকি আরও উদারহস্তে দেয়া হয়। ছয় বছর আগে ইংলাক সরকার বিশ্ব বাজারে বিরাজমান সূর্যের চাইতে মোটামুটি ৫০ শতাংশ বেশি দামে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনতে শুরু করেছিল। সরকারের এভাবে চাল মজুদ করার ফলে বিদেশে চালের কিছুটা দুষ্প্র্রাপ্যতা হওয়ার কথা ছিল। কারণ থাইল্যান্ড তখন ছিল বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ। ইংলাক সরকার চেয়েছিল বিশ্ববাজারে চালের ঘাটতি হলে তারা বেশি দামে ওই চাল বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে কৃষকদের দেয়া ভর্তুকি বাবদ সরকারের লোকসান পুষিয়ে নেবে। কিন্তু অন্যান্য রফতানিকারক দেশ বিশ্ববাজারের সেই ঘাটতি মিটিয়ে দেয়। ইংলাক সরকারের সেই স্কিমে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছিল এবং সরকারের শেষ পর্যন্ত লোকসান দাঁড়িয়েছিল ১৬শ’ কোটি ডলার। সেনাবাহিনী এটাকে অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। ইংলাক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সিনাওয়াত্রার অন্যান্য জনপ্রিয় নীতির মধ্যে ছিল একটি স্কিম যার দ্বারা গরিব ও অসুস্থরা মাত্র ১ ডলার পরিত্রাণ অর্থ ব্যয়ে ডাক্তার দেখাতে পারত। মাদকের বিরুদ্ধে থাকসিনের নির্মম অভিযানও বেশ জনসমর্থন পেয়েছিল। তার ছাত্রঋণও জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এই সমর্থন বা জনপ্রিয়তা সর্বব্যাপী ছিল না। শাসক জান্তা সে পরিস্থিতিকেও কাজে লাগিয়েছে। জান্তা সিনাওয়াত্রার বেশিরভাগ জনপ্রিয় নীতিই বহাল রেখেছে। ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের এখনও ভর্তুকি দেয়া হয়। ফসল কেটে তোলার আগে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা বাবদ সরকার গত সেপ্টেম্বর মাসে ২২০ কোটি ডলারের ঋণ ও সাহায্য অনুমোদন করে। জান্তা এ ধরনের সাহায্যের বাইরেও অগ্রসর হয়েছে। এক জনপ্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে জান্তা গত অক্টোবর মাসে এক নতুন সমাজকল্যাণ কার্ড চালু করেছে। যাদের আয় বছরে ১ লাখ বাতেরও কম তারা এই কার্ডের বদৌলতে মাসে ২০০ থেকে ৩০০ বাত পাবে যা হলো প্রায় সোয়া ৬ ডলারের সমান। এই শ্রেণীর আয়ের লোকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। তারা এই অর্থ দিয়ে চাল ও সাবানের মতো নির্দিষ্ট কিছু পণ্য নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকেই কেবল কিনতে পারবে। লোকে যত গরিব হবে ততই তারা বেশি পরিমাণে পাবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে জেনারেল বা সিনাওয়াত্রাদের কৌশল অবলম্বন করে জনগণের হৃদয় জয় করছে। তার ওপর সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের গণতন্ত্রকে নস্যাত করে দেয়া সত্ত্বেও রাজনীতিকদের ব্যাপারে এক ধরনের হতাশা ও বিরাগভাব জনগণের মধ্যে বিরাজ করছে। পাঁচজনের অধিক লোকের সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাজনীতিকদের পক্ষে ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের নীতি প্রচার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তাছাড়া সংবিধানের অধীনে থাইরা দেড় বছর আগে এক গণভোটে এই ব্যবস্থা অনুমোদন করেছে যে থাই পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদের সকল সদস্যকে সেনাবাহিনীই মনোনীত করবে এবং প্রধানমন্ত্রী পদে তাদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের মাত্র এক-চতুর্থাংশের সমর্থন লাগবে। ধারণা করা হচ্ছে যে, নির্বাচন যদি আদৌ হয় সে ক্ষেত্রে জান্তার নেতা প্রায়ুখ চানোচা প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই থেকে যাবেন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×