ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবারও ফাইনাল ‘জুজু’

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

আবারও ফাইনাল ‘জুজু’

ফাইনাল আসলেই যেন কোন এক অশরীরী আত্মা ভর করে সবকিছু ল-ভ- করে দেয়। কোন না কোনকিছু চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। আর বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে ফাইনাল। ২০০৯, ২০১৪, ২০১৬- এরপর আবার ২০১৮ সালে এসেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। আগের ওই তিন বছরে খেলা তিন ফাইনালে গিয়েই হেরেছিল বাংলাদেশ দল পুরো আসরে ভাল খেলে। আর এবারও পুরো আসরে ভাল খেলেও ফাইনালে গিয়েই হারতে হয়েছে। এর মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে অসহনীয় যন্ত্রণার চতুষ্টয়। প্রতিবারই আশ্চর্যজনকভাবে সাক্ষী হয়েছে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। ক্রমেই যেন ‘হোম অব ক্রিকেট’ যেন এক পৈশাচিক রূপ নিয়ে ভুতুড়ে আর গা ছমছমে অনুভূতির সৃষ্টি করছে। ২০০৯ সালে এমনই এক ত্রিদেশীয় সিরিজে মিরপুরে অনুষ্ঠিত ফাইনালে শেষ দুই ওভারের নাটকীয়তায় ২ উইকেটে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশের। ৯ বছর পর সেই লঙ্কানরাই ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে বাংলাদেশকে বড় ব্যবধানেই হারিয়ে দিল। যদিও রাউন্ড রবীন লীগের তিন ম্যাচে দোর্দ- প্রতাপ দেখিয়েই জিতেছিল টাইগাররা। ক্রিকেট বোদ্ধা থেকে শুরু করে বিশ্লেষকরা চোখ বন্ধ করে বলে দিচ্ছিলেন এবার শিরোপা বাংলাদেশের। কিন্তু দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে! বিধাতার ইচ্ছাতেই তো সব হয়, তিনি চেয়েছিলেন অন্যরকম। সবগুলো ম্যাচে টস জেতা বাংলাদেশ ফাইনালে এসেই হেরে গেল টসে। দুর্ভাগ্যের শুরু সেখান থেকেই। তিন ম্যাচে ব্যাটে-বলে একক নৈপুণ্যে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতানো সাকিব আল হাসান এমনই ইনজুরিতে পড়লেন যে আর বোলিংটাও শেষ করতে পারলেন না, ব্যাটিংও করতে পারলেন না। এতেই যেন আত্মবিশ্বাসের শক্ত পাঁজরটা ভেঙে গেল বাংলাদেশ দলের। হেরে গেল আবার ফাইনাল, শিরোপা নিয়ে গেল প্রতিপক্ষ। সাকিব আল হাসান ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়লেন। যেন বাংলাদেশের আশাও শেষ হয়ে গেল! ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে আশা তা হতাশাতেই পরিণত হয়ে গেল। ৭৯ রানে হেরে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়ে গেল শ্রীলঙ্কা। যে দলটি শুরুতে বিধ্বস্ত ছিল। সেই দলটিই কিনা বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে শিরোপা জিতে নিল। অভিষেক ওয়ানডেতেই শিহান মাদুশাঙ্কার হ্যাটট্রিকে শিরোপা জেতার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো বাংলাদেশের। ফিল্ডিংয়ের সময় সাকিব বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ব্যথা পান। এরপরই বোঝা হয়ে যায় যে ব্যাট হাতে নামতে পারবেন না। নয় ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান না থাকলে কী আর ম্যাচ জেতা এত সহজ! খুবই কঠিন। তা প্রমাণও হলো। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে শনিবার ফাইনাল ম্যাচটিতে টস জিতে যায় শ্রীলঙ্কা। আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রুবেল হোসেন (৪/৪৬) ও মুস্তাফিজুর রহমান (২/২৯) এমনই গতির ঝড় তুলেন, শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা কুলিয়ে উঠতে পারেননি। সাকিব মাত্র ৫ ওভার বোলিং করতে পেরেছিলেন, না হলে হয়তো আরও কম রানেই গুটিয়ে যেত লঙ্কানরা। কিন্তু বাংলাদেশ দলের জন্য বড় দুঃখটা ছিল ব্যাটিংয়ে নামার পর। সাকিব তিন নম্বরে নিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন। আগের চার ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছিল ৩৭, ৬৭, ৫১ ও ৮ রান। তিনি নামতেই পারলেন না। তাই তামিম ইকবালও যখন ব্যর্থ হলেন সাকিবহীনতায় ধসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের। ৪১.১ ওভারে ১৪২ রান করতেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ সর্বোচ্চ ৭৬ রান করতে পারেন। ফাইনালে এসে এমন হার কারও কল্পনাতেও ছিল না। যেন তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়া। একটি ম্যাচ খারাপ হতেই পারে। যে খারাপটা বাংলাদেশের হয়েছিল রাউন্ড রবীন লীগের শেষ ম্যাচে লঙ্কানদের বিপক্ষেই। মাত্র ৮২ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ইনিংস। আর প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে ১০ উইকেটে হারের লজ্জা বরণ করতে হয়। ওই ম্যাচটির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুইয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে মনে হচ্ছিল দুধের শিশু, যেন সবেমাত্র ক্রিকেট খেলা শিখছে। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুইয়েকে ৮ উইকেটে হারায় মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। বছরের প্রথম ওয়ানডেতেই এমন জয়ে আত্মবিশ্বাসে তরতাজা হয়ে ওঠে টাইগাররা। দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ১৬৩ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে দুই ম্যাচ হাতে রেখেই নিশ্চিত করে ফাইনাল। অথচ, এবার এই দলটি কোন প্রধান কোচ ছাড়াই নেমেছে খেলতে। সেই অভাবটা কেউ ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেনি। কিন্তু ছন্দপতনের শুরুটা হলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই। আবার শিরোপার কাছে গিয়েও তা হারানোর দুঃখটা সঙ্গী হলো। এর আগে তিনবার কোন টুর্নামেন্ট বা সিরিজের ফাইনালে খেলতে পেরেছিল বাংলাদেশ। ২০১২ সালের এশিয়া কাপে, ২০১৬ সালের টি২০ এশিয়া কাপে ফাইনালে খেলার সঙ্গে ২০০৯ সালের ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। সবকটি দেশের মাটিতে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই ফাইনালে খেলে। কিন্তু শিরোপা আর জিততে পারেনি। এবার চতুর্থবারের মতো ফাইনালে খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার কাছে টস হেরে মাত্র ২ উইকেটে, ২০১২ এশিয়া কাপে টস জিতে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে এবং ২০১৬ টি২০ এশিয়া কাপে ভারতের কাছে টস হারের পর বৃষ্টি ও ঝড়ে বিঘিœত ফাইনালে পরাজিত হয় বাংলাদেশ দল। অবশ্য, ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অবশ্য আছে। ২০০৭ সালে এ্যাসোসিয়েটস ত্রিদেশীয় সিরিজে কানাডা ও বারমুডার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলা সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু সেই সিরিজের ফাইনাল ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে কোন দল ছিল না ওই সিরিজে। টেস্ট খেলুড়ে দল আছে এবং তিন দলের সিরিজ বা টুর্নামেন্ট হয়েছে; এমন সিরিজ ১৩টিতে খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০৯ সালেই শুধু জিম্বাবুইয়ে ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালে খেলতে পারে বাংলাদেশ। টেস্ট খেলুড়ে তিন দলের সঙ্গে খেলা আর কোন সিরিজ বা টুর্নামেন্টেই ফাইনালে খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার খেলেছে। গত বছর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজেরও ফাইনাল হয়নি। সেখানে বাংলাদেশ একটি খেলা বৃষ্টিতে প- হওয়ার কারণে পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। শিরোপা জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। কিন্তু এবার যে দাপটের সঙ্গে সিরিজের শুরুটা হয়েছিল, তাতে চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে বাংলাদেশকেই ধরা হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশ, তা মনে করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো কোন সিরিজে শিরোপা জিতবে, তা ভাবা হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা তা হতে দিল না। বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে উল্টো শিরোপা জিতে চ্যাম্পিয়ন হল। আবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অধরাই থেকে গেল। ফাইনাল যেন বাংলাদেশ দলের জন্য ‘জুজু’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল।
×