ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

অকালে অবসরে ফুটবলার ওয়াহেদ

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

অকালে অবসরে ফুটবলার ওয়াহেদ

বাবা অনেক স্বপ্ন দেখতেন যেন আমি দেশের হয়ে ফুটবল খেলি। তার স্বপ্ন পূরণ অনেক ইচ্ছা ছিল দেশের ফুটবলকে ভাল কিছু দেয়ার। ইচ্ছাটা পুরোপুরিভাবে পূরণ হলো না। পরিবারকে সময় দিতে ফুটবল থেকে অবসর নিচ্ছি। দেশের হয়ে খেলতে পারব না, এটা সত্যি কষ্টকর। কিন্তু জীবন অনেক কঠিন। অনেক বেশি মিস করব দেশের ফুটবলকে। ফুটবলার হওয়ার পেছনে যারা আমাকে সাপোর্ট করেছেন, বিশেষ করে আমার পরিবার, কোচ, সতীর্থ আর আপনারা, সবাইকে অনেক বেশি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনেক বেশি ধন্যবাদ জানাই সিলেটের সবাইকে। আপনাদের ভালবাসা না পেলে এতদূর আসতাম না। জানি, আমার এই সিদ্ধান্তে অনেকেই কষ্ট পাবেন। ক্ষমা করে দেবেন। আমার জন্য দোয়া চাইবেন। ভাল থাকবেন। ২০১৭ সালের ২ মে কথাগুলো বলেছিলেন ওয়াহেদ আহমেদ। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই ফুটবল ক্যারিয়ারের যবনিকাপাত ঘটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যে বাবা চাইতেন ছেলে ফুটবল খেলুক, সেই বাবাই চেয়েছিলেন ছেলে যেন ফুটবল ছেড়ে লন্ডনে তার রিয়েল এস্টেট এবং রেস্তরাঁর ব্যবসার হাল ধরুক। সে অনুযায়ী লন্ডনে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চালু করার পর এবার ওয়াহেদ বাংলাদেশে নিজের শহর সিলেটের শিবগঞ্জে চালু করতে যাচ্ছেন রেস্তরাঁর ব্যবসা। নাম ‘ওয়াহেদ’স ডিনার’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র শিবগঞ্জে উদ্বোধন করতে যাচ্ছি অত্যাধুনিক এই রেস্টুরেন্টটি। সবার কাছে দোয়া এবং সহযোগিতা প্রার্থী।’ ইতোমধ্যেই এ উপলক্ষে গত রবিবার মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর ওয়াহেদ যখন বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেনÑ তখন ফুটবলপ্রেমীরা খুবই বিস্মত হয়েছিলেন স্বভাবতই। প্রশ্ন করেছিলেন, এত আগেই কেন এই অবসর? এর সদুত্তর না দিলেও বাংলাদেশের ফুটবলের এখন যে দুর্দশা চলছে, তাতে করে এদেশে ফুটবল খেলে যে কোন লাভ-ভবিষ্যত নেইÑ সেটাও হয়ত বুঝে থাকবেন ওয়াহেদের বাবা। তাই হয়ত ছেলেকে এভাবেই বুঝিয়েছিলেন। তবে ওয়াহেদের ফুটবল ছাড়ার এটিই একমাত্র কারণ নয়। আরেকটি কারণও আছে। ২০১৭ সালের শুরুতেই লন্ডনে পাড়ি জমান ওয়াহেদ। লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশী কন্যা শাহনাজ প্রিয়াকে বিয়ে করেছিলেন ২০১৪ সালে। প্রায় তিন মাস সেখানে অবস্থান করার পর ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ দেশে ফেরেন তিনি। প্রস্তাব পাচ্ছিলেন বিভিন্ন ক্লাব থেকে। তবে ভক্তদের আশায় জল ঢেলে দেন তিনি। দেশে তিনি ফেরেন ঠিকই। তবে তার এই ফেরাটা আসন্ন ফুটবল মৌসুমকে কেন্দ্র করে নয়। পাকাপোক্তভাবে দেশের ফুটবল থেকে বিদায় নেয়ার জন্য। নিয়ে ফেলেন কঠিন সিদ্ধান্তÑ এখন থেকে লন্ডনেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন তিনি। কারণ স্ত্রী শাহনাজও চান না, তার স্বামী তাকে ছেড়ে বাংলাদেশে পড়ে থেকে ফুটবল খেলুক! ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান সিলেটের এই ফুটবলার। আর ফিরবেন না দেশে খেলতে। ঢাকার ফুটবলে মাঠে নামবেন না। ঢাকা আবাহনীও আর সাইডবেঞ্চে বসিয়ে রাখার সুযোগ পাবে না মোহামেডানের এক সময়কার দলপতি ওয়াহেদকে। যে সম্ভাবনা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ওয়াহেদ, সেই সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন, জায়গা পেয়েছিলেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের স্কোয়াডে, ২০১৩ সালে। ২০১৬ সালে খেলেছিলেন এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে। এতসব অর্জন দিয়ে যখন ক্যারিয়ারকে গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই পরিবারের টানে ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই ফুটবলার ঘরোয়া ফুটবলে সর্বশেষ খেলেছিলেন ঢাকা আবাহনীতে। ১০ নম্বর জার্সিধারী এই ফরোয়ার্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন পাঁচ ম্যাচ। ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনী ও মোহামেডানÑ দুই দলের হয়েই খেলার অভিজ্ঞতা তার আছে। ওয়াহেদ নিজেকে সর্বপ্রথম চেনান ২০১৩ সুপার কাপে। বিদেশীহীন এ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের মোট গোলসংখ্যা ছিল পাঁচ। তার মধ্যে ওয়াহেদ নিজে করেন তিন গোল আর উৎস ছিলেন বাকি দুটি গোলের। এ সুবাদে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় দলের তৎকালীন ডাচ্ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফও তাঁর মধ্যে খুঁজে পান স্ট্রাইকারসুলভ গুণাগুণ। এরপর সোজা সাফের জাতীয় দলে মোহামেডানের এই স্ট্রাইকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ফেডারেশন কাপে সাদাকালোর একাদশে তার ঠাঁই হয়নি! বদলি হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেন ২০ মিনিট, ১০ মিনিট ও ৫ মিনিট করে। এর মধ্যেও একটি গোল করেন রহমতগঞ্জের বিপক্ষে। লীগের শেষদিকে এসে ইনজুরি আক্রান্ত মোহামেডানের নিয়মিত অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলির অনুপস্থিতি ঢেকে দেন ওয়াহেদ। মূলত তাঁর কল্যাণেই শেষদিকে ছন্দে ছিল ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। সেবারের ম্যারাথন লীগে (২০১৩) ২৭ ম্যাচে মোহামেডান করে ৩৬ গোল। এর ১৫টিই করেন ওয়াহেদ। অথচ দলের হয়ে সব ম্যাচও খেলানো হয়নি তাঁকে। খেলেন ১৮-১৯টি ম্যাচ! এর আগে ২০১১ সালেও জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পেয়েও পড়েছিলেন ওয়াহেদ। ওয়াহেদের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু ২০০৬ সালে। মোহামেডানের জুনিয়র টিমের হয়ে। মূলত প্রতিভা অন্বেষণ প্রক্রিয়াতেই তার আগমন। কোচ ছিলেন শফিকুল ইসলাম মানিক, সহকারী ছিলেন সাইফুল বারী টিটু। এরপর ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের হয়ে খেলেন ২০০৭-০৯ পর্যন্ত। ক্লাবের হয়ে খেলে এক মৌসুমে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন। তারপর শেখ রাসেল ২০১০ মৌসুমে। তারপর মোহামেডানে ২০১১-১৪ পর্যন্ত খেলে সর্বশেষ খেলেন আবাহনীর হয়ে। সাইড বেঞ্চে বসে থেকে সর্বশেষ ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ মৌসুমে গোল পাননি সেভাবে (১০ গোল)। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের প্রতি ম্যাচের নায়ক বিদেশী। স্ট্রাইকিং জোনে সবসময় আমাদের ক্লাবগুলোতে বিদেশীরা খেলে। এক ম্যাচ, দুই ম্যাচ খারাপ করলেও তাদের বসিয়ে রাখা হয় না। দেশীদের বেলায় এক ম্যাচ খারাপ করলেই রিজার্ভ বেঞ্চে জায়গা হয়ে যায়। এর মধ্যেও ওয়াহেদ নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন বিভিন্ন সময়। সে সময় ওয়াহেদকে নিয়ে আলাদাভাবে বলতে গিয়ে কোচ ডি ক্রুইফ বলেছিলেন, ‘আমাকে সুপার কাপের আগে ওয়াহেদ সম্পর্কে কেউ কিছু বলেনি। সুপার কাপ দেখেই আমি তাকে ক্যাম্পে ডেকেছি। সে উন্নতি করেছে।’ যার প্রিয় ফুটবলার আলফাজ, এমিলি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, সেই ওয়াহেদের পারিবারিক কারণে ফুটবল ছেড়ে দেয়াটা স্বভাবতই বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদের নাড়া দিয়েছিল। এখন দেখার বিষয়Ñ ফুটবল ছেড়ে পুরোদস্তুর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী বনে যাওয়া ওয়াহেদ নতুন ভূমিকায় কতটা সফল হন।
×