ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মন্টিভিডিও টু মস্কো

বিশ্বকাপকথন-৪ ॥ দ্বিতীয় বিশ্বকাপ : ইতালি ১৯৩৪

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-৪ ॥ দ্বিতীয় বিশ্বকাপ : ইতালি ১৯৩৪

২০তম বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আলোচনা সরগরম হতে শুরু করেছে চায়ের টেবিলে। আর ক’দিন পর উঠবে চায়ের কাপে ঝড়। বলতে গেলে দরজার ওপাশে উঁকি দিচ্ছে ২১তম বিশ্বকাপ। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ২১তম বিশ্বকাপের টিকেট বিক্রি। আগেই বলেছি, ১৪ জুন শুরু হয়ে এ প্রতিযোগিতা শেষ হবে ১৫ জুলাই। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করছে রাশিয়া সে কথাও সবার জানা। রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী ও সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথা সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন... প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া ছিল। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসবে। আর সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় আসর বসে ১৯৩৪ সালে। এবারে ফিফার ৪৬টি দেশের প্রতিনিধিদের আয়োজক নিয়ে এতটুকু ভাবতে হলো না। প্রথম বিশ্বকাপ যেহেতু ল্যাটিনে হয়েছে এবার যে ইউরোপে হবে তা নিয়ে কারও মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না। কেবল সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা কোন দেশে অনুষ্ঠিত হবে। এবারো আলোচনার শীর্ষে ছিল জুলে রিমের ফ্রান্স। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি ধোপে টেকেনি। আলোচনায় সুরাহা না হওয়ায় ফিফাকে এবারও ভোটে যেতে হয়। বেশি পড়ে ইতালির পক্ষে। ফলে ইউরোপ থেকে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় ইতালি। এবারে বিশ্বকাপের মূল পর্বে ১৩টির স্থানে অংশ নেয় ১৬টি দেশ। এই ১৬টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৩৪টি দেশের মধ্যে থেকে। মজার ব্যাপার হলো এই ষোলটি দলের মধ্যে ১২টিই ছিল ইউরোপের। ইইরোপের বাইরে দুই আমেরিকার ৩ দল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়। এ ছাড়া প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে খেলে মিসর। তবে এ বিশ্বকাপের সবচে’ অবাক করা ঘটনা ছিল এটাই যে প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে রহস্যজনকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। আর এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের রং একটু হলেও ফিকে হয়ে যায়। হাজার হলেও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দলের অংশগ্রহণ না করা বলে কথা। কথায় বলে, কারও জন্য কোন কিছু থেমে থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বকাপও থেমে থাকেনি। যথারীতি সফলভাবে শেষও হয়েছে। ফুটবলের আদি পিতা ইংল্যান্ড এ বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি। এবারই প্রথম ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে থেকে প্রথম দল হিসেবে আফ্রিকার মিসর বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া থেকে এবারও কোন দেশ খেলার সুযোগ পায়নি। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ থেকেÑ ইতালি, জার্মানি, চেকোশ্লাভাকিয়া, রুমানিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া স্পেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, হাঙ্গেরি; কনমোবল থেকে : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা; কনকাকাফ থেকে : যুক্তরাষ্ট্র; আফ্রিকা থেকে : মিসর দ্বিতীয় বিশ্বকাপে অংশ নেয়। মূল পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ১৭টি ম্যাচ। ইতালির ৮টি স্টেডিয়ামে এই ১৭টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ১৩টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হলেও এবারে এক অদ্ভুত নিয়মে খেলা হয়। এ অবাক করা নিয়ম অনেকে মন থেকে মানতে পারেননি। অনেকে মনে করেন, স্বাগতিকদের কাপ পাইয়ে দিতেই এ নিয়ম করা হয়। এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেয় ১৬টি দল। ফলে গ্রুপ করা ছিল আরও সহজ। তা না করে আয়োজকরা নক আউট পদ্ধতিতে খেলার সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কারও বোধগম্য হয়নি। অর্থাৎ এ বিশ্বকাপের ১৬টি দল প্রথম রাউন্ডে নক আউট পদ্ধতিতে খেলে। যার কারণে প্রথম রাউন্ডেই ৮টি দল বাদ পড়ে যায়। আর যারা বাদ পড়ে তার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল টপ ফেবারিট দল। বিশ্বকাপের মতো এতবড় আসরে একটা মাত্র ম্যাচ দিয়ে একটি দলকে বিচার করা যায় না। যার ফলশ্রুতিতে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা, সেমি-ফাইনালিস্ট যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মতো দল প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। ফলে বিশ্বকাপ অনেকটা পানসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় রাউন্ড হয়ে যায় ‘অল ইউরোপ গেম’। এটি তখন আর বিশ্বের বিশ্বকাপ না হয়ে ‘ইউরোপের বিশ্বকাপ’ হয়ে যায়। সেমি-ফাইনালেও অবস্থা তথৈবচ। ৪টি দলই ইউরোপের। গ্রুপ পর্বে ইতালি ৭-১ গোলে যুক্তরাষ্ট্রকে, প. জার্মানি ৫-২ গোলে বেলজিয়ামকে, হাঙ্গেরি ৪-২ গোলে মিশরকে হারিয়ে বড় জয় পায়। দ্বিতীয় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইউরোপের স্বাগতিক ইতালি বনাম পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ বনাম আমেরিকার লড়াইয়ে এবারও জেতে ইউরোপ। ইতালি ৭-১ গোলে উড়িয়ে দেয় আমেরিকানদের। ইতালির শিয়াভিও প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন। প্রথম বিশ্বকাপে আমেরিকার সাফল্যে সবাই অবাক হয়েছিল। যদিও তারা ততটা ফেবারিট ছিল না। তারপরও তারা সেবার সেমিতে উঠে চমক দেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বকাপে মার্কিনীরা ভাল তো করতে পারেনি, বরং ইতালিয়ানদের কাছে সাত গোলের নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে। ইউরোপের অল আউট ফুটবলের কাছে মার খেতে হয়েছে। প্রথম বিশ্বকাপের সব অর্জন বিসর্জন দিয়ে দেশে ফিরতে হয় মার্কিনীদের । গ্রুপ পর্বের ফলাফল : ইতালি-৭ যুক্তরাষ্ট্র-১; স্পেন-৩ ব্রাজিল-১; অস্ট্রিয়া-৩ ফ্রান্স-২, হাঙ্গেরি-৪ মিসর-২; চেকোশ্লাভাকিয়া-২ রুমানিয়া-১; সুইজারল্যান্ড-৩ নেদারল্যান্ড-২; জার্মানি-৫ বেলজিয়াম-২; সুইডেন-৩ আর্জেন্টিনা-২; দ্বিতীয় রাউন্ড : : ইতালি-১ (১) স্পেন-১ (০); অস্ট্রিয়া-২ হাঙ্গেরি-১; জার্মানি-২ সুইডেন-১; চেকোশ্লাভাকিয়া-৩ সুইজারল্যান্ড-২; সেমি-ফাইনাল : ইতালি-১ অস্ট্রিয়া-০; চেকোশ্লাভাকিয়া-৩ জার্মানি-১; তৃতীয় স্থান : জার্মানি-৩ অস্ট্রিয়া-২; ফাইনাল : ইতালি-২ চেকোশ্লাভাকিয়া-১। প্রথম সেমিফাইনালে শিরোপার অন্যতম দাবিদার টপ ফেবারিট প. জার্মানি অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায় চেকদের কাছে। এ বিশ্বকাপের হট ফেবারিট দল ছিল জার্মানরা। তাদের হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে ওঠে চেকোশ্লাভাকিয়া। অপর সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইতালি ১-০ গোলে হারায় আরেক ইউরোপিয়ান দল অস্ট্রিয়াকে। রোমের ‘অল ইউরোপ গ্রান্ড ফাইনাল’র হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর স্টেডিয়ামে উপস্থিত দেড় লাখ ফুটবলানুরাগীকে সুখ-সাগরে ভাসিয়ে শেষ হাসি হাসে আবারও স্বাগতিকরা। প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপাও জেতে স্বাগতিক উরুগুয়ে। বিরতির আগে স্বাগতিক ইতালি ২-১ গোলে এগিয়ে থাকলেও বিরতির পর আর ব্যবধান বাড়ানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই ২-১ এর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইতালি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ইতালির নেতৃত্ব দেন কম্বি আর চেকোশ্লাভাকিয়ার প্লানিকা। দুজনেই ছিলেন গোল-কিপার। জার্মানি পায় তৃতীয় স্থান। ইতালির এ্যানজেলো শিহাবো বিশ্বকাপের শততম গোলটি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও মোট ৭০টি গোল হয়। ইতালির শিয়াভিও ছাড়াও হ্যাটট্রিক করেন জার্মান স্ট্রাইকার কনেন। দ্বিতীয় বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন চেক ফুটবলার অলডিচ নেজলি। তিনি ৫টি গোল করে এ বিশ্বকাপের ‘টপ স্কোরার’ হন। এ বিশ্বকাপের একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এ বিশ্বকাপে কোন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেননি। দ্বিতীয় বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন সুইডেনের রেফারি একলিন্ড। অনেক কারণে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ নন্দিত-নিন্দিত হয়ে থাকবে। ইতালি কাপ জিতলেও তাদের সে জয় আনন্দের হয়নি। নিন্দুকদের আয়োজনের পদ্ধতি, লটারিসহ অনেক বিষয়ে আয়োজকদের দিকে আঙ্গুল তুলতে দেখা যায়। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×