ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চালকের কানে মোবাইল-প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণ যাচ্ছে নিষ্পাপ যাত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

চালকের কানে মোবাইল-প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণ যাচ্ছে নিষ্পাপ যাত্রীর

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা নিষেধ! কিন্তু এ আইন মানে কয়জন? আর তাইতো প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশসহ বর্তমানে সারা বিশ্বেই গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলায় যত্রতত্র দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। শুধু চালকের খামখেয়ালিপনায় রাজপথে ঝরে যাচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি ভারতের বহরমপুরের কাছে দৌলতাবাদে ঘটে গেছে এমনই এক ভয়াবহ ঘটনা। যার কারণে প্রাণ গেছে ৩৬ নিষ্পাপ যাত্রীর। যাত্রীদের ট্রেন ধরার তাড়া ছিল। চালকের কানে মোবাইল ছিল। সামনে একটা গাড়ি ছিল। তীব্র গতিতে পাশ কাটাতে গিয়ে মুর্শিদাবাদের বালির ঘাট সেতু থেকে ভাণ্ডারদহ বিলে পড়ে গেল বাস। এ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩৬ জন ও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৩ জন। জানা গেছে, সোমবার সকাল ৭টা নাগাদ বহরমপুরের কাছেই দৌলতাবাদে দুর্ঘটনাটি ঘটে। নদিয়ার করিমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হয়ে মালদহে যাওয়ার কথা ছিল বাসটির। ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ কথাগুলো আমাদের সকলের জানা থাকলেও সামান্যতম কারণে যে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার উদাহরণ এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সম্প্রতি গাড়ি চালানোর সময় চালকের মোবাইলে কথা বলা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বাস, ট্রেন, ট্রাক, প্রাইভেট কার, লেগুনা, মোটরসাইকেল, সিএনজি এমনকি রিক্সাচালকেরা চলন্ত অবস্থায় ফোন কানে নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত থাকেন। এ বিষয়ে আইন থাকা সত্ত্বেও কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ চলন্ত অবস্থায় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, অনেকে মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন চলন্ত অবস্থায় চালক কথা বলাকে। রাজধানীসহ সারাদেশে হরহামেশা এ চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এভাবে কথা বলার কারণে রাজধানীতেও প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি যেসব বড় দুর্ঘটনা ঘটছে তার প্রধান কারণও এই মোবাইল ফোনের ব্যবহার। ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায় চালক গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় যাত্রীবাহী বাসের চাপায় তিন পথচারী নিহত হন সেই সঙ্গে আহত হন ১৫ জন। জানা যায়, বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা সোনারতরী পরিবহনের একটি বাস ভবকদিয়া বাজারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে চলে যায়। এ সময় রাস্তার পাশে থাকা তিন ব্যক্তি বাসটির নিচে চাপা পড়ে মারা যান। ভাঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ জানায়, চালক মোবাইলে কথা বলছিলেন। এই কারণেই হয়তো বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে চলে যায়। ওই বছরের ২৫ মে ঠিক এমনই আরও একটি ঘটনা ঘটে। ঢাকা এশিয়ান বাইপাস রোডের সোনারগাঁ উপজেলার বস্তুল এলাকায় ঘটনার দিন সকালে একটি গার্মেন্টসের ভাড়া করা যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে উল্টে পড়ে যায়। সে সময় ঘটনাস্থলে ১ গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত ও ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়। আহত যাত্রীরা জানান, গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলায় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে যায়। কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি জানান, চালকের অনবধানতার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। যার কারণে বছরের পর বছর সামান্য অনবধানতা ও অসচেতনতার কারণে প্রাণ যাচ্ছে অনেক যাত্রী ও পথচারীর। একই বছরের ৭ এপ্রিল মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনে কাটা পড়েন এক ব্যবসায়ী। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে এ ঘটনাটি ঘটে। ঢাকা রেলওয়ে থানা (জিআরপি) পুলিশের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেললাইনে ৩০০টি লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্য ১৫০ জনই মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন। গাড়ি চালানোর সময় যেমন কানে ফোন অথবা এয়ারফোন লাগানো থেকে চালকদেরকে বিরত থাকতে হবে ঠিক তেমনি জনগণের সচেতনতায় পারে আকস্মিক এসব দুর্ঘটনা থেকে রোধ করতে। চলন্তু অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার রোধে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা রোধ করতে ২০০৭ সালে মোটরযান আইনের সংশোধন করা হয়। ওই বছর ১২ জুলাই গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলার বিষয়ে মোটরযান আইনের ১১৫(বি) ধারার সংশোধন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি আইনে এয়ারফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইন অমান্য করলে পাঁচশত টাকা জেল জরিমানার করার বিধান রয়েছে। কিন্তু হরহামেশা এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। ভারতেও এ ধরনের একটি আইন রয়েছে। আইন অমান্য করলে দুই হাজার টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের জেল দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভারতের আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের আইনের পার্থক্য হলো বাংলাদেশের আইনটি যেমন দুর্বল, তেমনি এর কোন প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ছোট-বড় ৪ হাজার ৯৭৯ টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে সর্বমোট ২৩ হাজার ৫৯০ জন যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে সর্বমোট ৭ হাজার ৩৯৭ জন, আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৯৩ জন। এর মধ্যে হাত, পা বা অন্য কোন অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে ১ হাজার ৭২২ জন। সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ৪৩১২ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছিল। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে। এতে দেখা গেছে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মোট দুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ, নিহত ২২ দশমিক ২ শতাংশ, আহত ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। সম্প্রতি যে সব বড় দুর্ঘটনা ঘটছে তার পেছনে রয়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় চালক প্রায় অসতর্ক অবস্থায় থাকে। এছাড়া পাশে বসা অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় অসতর্ক হয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালায়। কিন্তু যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায়, এসব চালকের অনেকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। হেলপার হয়ে ড্রাইভারের কাজ করা, চলন্ত গাড়িতে চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার একটি স্বভাবে পরিণত হয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন থাকলে তার কোন প্রয়োগ নেই। শুধু দুর্ঘটনা ঘটলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তৎপর হতে দেখা যায়। আবার সবকিছু হয়ে যায় আগের মতো। কিন্তু মাঝখানে যে তরতাজা প্রাণগুলো হারিয়ে যায় তা কোনদিন ফিরে পাওয়ার নয়। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বার্ষিক পরিসংখ্যান নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গৃহীত কর্মসূচী যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে অদক্ষ ড্রাইভার ও অমনোযোগী হয়ে গাড়ি চলানোর জন্য মূলত দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ’ সড়ক পরিবহন আইনের ব্যাপক দুর্বলতা আছে মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে মহামারী হিসেবে চিহ্নিত। অথচ আমাদের দেশে সড়ক পরিবহনের কার্যকর কোন আইন নেই। আশা করছি এ বছর কার্যকর একটি আইন প্রণয়ন হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। আইনে জেল জরিমানার বিধানও রয়েছে। কিন্তু আইন মানার প্রবণতা কারও মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। মূলত আইন অমান্য করে গাড়ি চালানোর কারণে দেশে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের প্রত্যেকটি সড়ক-মহাসড়ক ডিজিটাল নজরদারিতে নিয়ে আসা, ড্রাইভিং স্কুল করা ও চালকদের বেপরোয়া মনোভাব নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেন। এ বিষয়ে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়ক দিবস পালন অনুষ্ঠানে বলেন, মোবাইল ফোনের ব্যবহার রোধে মাত্র পাঁচশত টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তাও কার্যকর করা হচ্ছে না। জরিমানার বিধান পাঁচশত টাকার বেশি করে এসব চালকের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা না গেলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এসব বেপরোয়া চালকের পেছনে রয়েছে তাদের শক্তিশালী সংগঠন। কোন রকম দুর্ঘটনায় চালক একবার প্রাণে বেঁচে গেলে তাদের বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে সংগঠনগুলো। ফলে তাদের আর শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারী উদ্যোগ ॥ দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো ব্ল্যাক স্পট নাম দিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সারা দেশে ২০৮টি ব্ল্যাক স্পটের তালিকা তৈরি করেছে। যৌথ গবেষণার এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে সড়ক বা মহাসড়কের ওপর গড়ে তোলা বাসস্ট্যান্ডগুলোতেই। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্ত, চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা ও ব্যাটারিচালিত অবৈধ যানবাহন বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আর পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে প্রচার চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে চালকদেরকেও নির্দিষ্ট আইন মেনে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
×