ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়োস্কোপ

শিশু-কিশোররা দেখে মুগ্ধ হতো, হারিয়ে যাচ্ছে লোক ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

শিশু-কিশোররা দেখে মুগ্ধ হতো, হারিয়ে যাচ্ছে লোক ঐতিহ্য

খলিলুর রহমান ॥ বায়োস্কোপ। গ্রাম বাংলার শিশু-কিশোরদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আগেকার দিনে গ্রাম-গঞ্জের যেখানে সেখানে হামেশা দেখা যেত বাক্সবন্দী বায়োস্কোপ। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের এই ঐতিহ্য। আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে গ্রাম বাংলার মেলা ও হাট-বাজারে এখন আর বায়োস্কোপের দেখা মিলে না। গ্রাম বাংলার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ একসময় বায়োস্কোপ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। বায়োস্কোপের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নানা ঐতিহ্যের স্থিরচিত্রের (ছবি) মাধ্যমে ইতিহাসের কথা জানতে পারত। বায়োস্কোপ দেখতে বায়না ধরত শিশু-কিশোররা। বায়োস্কোপ দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো আনন্দ উপভোগ করতেন। আর বায়োস্কোপ প্রদর্শনকারী নেচে গেয়ে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী লোকদের আকৃষ্ট করতেন। মাতিয়ে রাখতেন বায়োস্কোপ দেখার সময়টুকু। বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে ফেরিওয়ালা চেঁচিয়ে বলতেন, ‘বায়োস্কোপ দেখবেননি বায়োস্কোপ ...।’ এ ধরনের শব্দ শুনে ছুটে আসত শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী লোক। কিন্তু দিন দিন পাল্টে গেছে গোটা দৃশ্যপট। আধুনিককালে এই বায়োস্কোপ এখন বিলুপ্তের পথে। কেউ আর ডিজিটাল যুগে এসে এই বায়োস্কোপ দেখতে চায় না। এমনকি কেউ খোঁজ-খবরও নিচ্ছে না বায়োস্কওয়ালার। তাদেরই একজন রাজশাহীর বাগমারার চাইনছড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জলিল ম-ল। তিনি এ বছর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও লোক ও কারু শিল্পমেলা ও লোকজ উৎসবে তার বায়োস্কোপ বক্স নিয়ে ছুটে এসেছেন। তিন বছর ধরে এ লোক ও কারু শিল্পমেলা ও লোকজ উৎসবে আসছেন। সম্প্রতি জাদুঘরে ছুটে আসা বিনোদন প্রিয়াসী শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী লোকদের সেই ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ নেচে গেয়ে দেখিয়েছে। এক হাতে প্রেমজুড়ি বাজিয়ে অন্য হাতে বাক্সের চাবি ঘুরিয়ে স্থির চিত্র প্রদর্শন করেন জলিল ম-ল। বাক্সের আতশ কাঁচে চোখ রেখে স্থিরচিত্র দেখে উৎফুল হয় শিশু, কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ। তিনি তার কণ্ঠে বায়োস্কপে কী কী প্রদর্শন করা আছে, তা ছন্দে-নেচে গেয়ে তার বর্ণনা দেন। তার কণ্ঠে ছিল ‘এইতো দেখেন গোলাগুলি বাইজ্যা গ্যাছে, হাজার হাজার সৈন্য আছে, কত সৈন্য শহীদ হলো, ডানে-বামে লক্ষ্য করেন, এবারেতে দেখেন ভাল শহীদ মিনার কাছে আছে, এবারেতে দেখেন ভাল বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে। এবারেতে দেখেন ভাল শেখ হাসিনা সামনে আছে, ইন্দিরাগান্ধী পাশে আছে, দেখেন কত বাহার আছে, এবারের দেখেন ভাল, কলকাতা শহর আছে, বড় লোকের বাড়ি আছে, হাইকোর্টের কাচারি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল আমেরিকা শহর আছে, এক শ’ তলা বাড়ি আছে। এই বাইরেতে দেখেন ভাল ভিষণ যুদ্ধ ব্যাইজা গ্যাছে, কত বিমান উড়া গেছে, কত বিমান পড়াই রইছে। এবারেতে দেখেন ভাল দিল্লীর শহর আছে। লন্ডন শহর দেখা যাচ্ছে, সারি সারি বিল্ডিং আছে, পাহাড় আছে, ঝর্ণা আছে, নবারের বাড়ি আছে, তামহল আছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। আর কত কি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল ফাঁকা ময়দান পড়ে রইল.... এভাবেই বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন আব্দুল জলিল ম-ল। আবদুল জলিল ম-লের বাপ-চাচা ও দাদার পেশা এটি। এখনও জলিল ম-ল বায়োস্কপের পেশা ছাড়তে পারেননি। রক্তের সঙ্গে মিশে আছে তার এ পেশা। জলিল ম-লের পিতার নাম বকশি ম-ল। তার চাচা শান্তি ম-লও এ পেশায় যুক্ত ছিলেন। জলিল ম-লের বয়স পঞ্চান্নোর্ধ। চল্লিশ বছর বয়স থেকেই তিনি বায়োস্কোপ দেখানোর পেশায় নেমে পড়েন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আধুনিক যুগে এখন আর কেউ বায়োস্কোপ দেখতে চান না। টিভি, ডিশ, মোবাইল ফোন এসে যাওয়া এখন বায়োস্কপের কদর কমে গেছে। তিনি জানান, বর্তমানে তার বায়োস্কপে রয়েছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, তাজমহল, বিশাল অট্টালিকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। ঝর্ণা, পাহাড় পর্বতের ছবি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি, কলকাতা শহরের ছবি ও হাইকোর্টের ছবি নানা দর্শনীয় স্থান। আগে বায়োস্কপের দেখানো হতো বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ছবি, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, রাম লক্ষ্মণের যুদ্ধ, স্বর্গ ও নরকের কাল্পনিক চিত্র, মক্কা ও মদীনাসহ আরও কয়েকটি স্থিরচিত্র। তিনি জানান, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবিও পাল্টাতে হয়। বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে তিনি এখন বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন। তার বায়োস্কপে কাঁচের সামনে ৬ জন এক সঙ্গে দেখতে পারেন। এতে ৪০টি ছবি লাগানো হয়েছে। প্রতিটি ছবি দেড় ফুট আয়তনের। মোট ৪০-৪৫ ফুট ছবি দেখানো হয়। প্রতিজনকে এখন ১০ টাকা দিতে হয়। প্রায় ৫-১০ মিনিট দেখানো হয় বায়োস্কোপ। তার বায়োস্কোপ দেশের ঐতিহ্য। কিন্তু কারও সহযোগিতা পাচ্ছে না তিনি। কেউ তাদের খোঁজ-খবরও নিচ্ছে না। এখনও গ্রাম-গঞ্জে বায়োস্কোপ দেখালে নগদ টাকার পরিবর্তনে চাউল দেয়া হয়। বায়োস্কোপ দেখিয়ে যা পাওয়া যায় এ দিয়ে তার সংসার চলে।
×