ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বদলে যাচ্ছে তরুণরা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

বদলে যাচ্ছে তরুণরা

যুব সমাজের আচরণ বদলে যাচ্ছে। একই বয়সের তরুণরা তাদের পূর্বসূরিদের তুলনায় ভিন্ন আচরণ করছে, ভিন্ন চিন্তা করছে। আমেরিকা থেকে শুরু করে নেদারল্যান্ডস হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশেই এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছু কিছু পরিবর্তন বহু বছর ধরে চললেও গত ক’বছরে তা ত্বরান্বিত হয়েছে। পরিবর্তনগুলো সবই যে নির্দোষ ধরনের মনে করার কোন উপায় নেই। সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন সম্ভবত এই যে তরুণরা আগের চেয়ে কম মাতলামি করছে। মদ্যপান শুরুও করছে পরে। অস্ট্রেলিয়ায় তরুণরা গড় যে বয়সে এ্যালকোহল পান শুরু করে ১৯৯৮ সালে তা ছিল ১৪.৪ বছর। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.১ বছর। ব্রিটেনে ১৬ থেকে ২৪ বছরের তরুণদের এক-পঞ্চমাংশ আদৌ মদ্যপান করে না। সেখানে পরের সংখ্যা বছরে প্রায় এক হাজার করে কমছে। নাইট ক্লাবের অবস্থা তো আরও খারাপ। অন্যান্য নেশাকর দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণও কমছে। ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা যারা সিগারেট ধরে ১৯৯৯ সাল থেকে তাদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ্যালকোহল, তামাক, গাঁজা, ঘুমের ওষুধসহ নেশাকর কোন কিছু সেবন করে দেখেনি এমন কিশোর-কিশোরীর সংখ্যানুপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব জিনিস থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকাদের হার সুইডেনে ২০০৩ সালে যেখানে ছিল ১১ শতাংশ সেখানে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশ। আর আইসল্যান্ডে সেই হার ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় মারিজুয়ানাবাদে আর সকল বেআইনী মাদকদ্রব্যের জনপ্রিয়তা কমেছে। কিশোর বয়সীদের আফিম সেবন হ্রাস পাওয়ার হার লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। তরুণদের একে অপরের ক্ষতিসাধন করার প্রবণতা কমে আসছে। ১৩ ও ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ইউরোপজুড়েই হ্রাস পেয়েছে। কিশোর অপরাধ ও সমাজবিরোধী আচরণ ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে কমেছে এবং সেই সঙ্গে কমেছে সাজাপ্রাপ্ত কিশোর অপরাধীর সংখ্যাও। কিশোরদের যৌন আচরণ বিশেষ করে যে সব সেক্সের পরিণতিতে বাচ্চাও জন্মেছে তেমন ঘটনাও কমে এসেছে। ১৯৯১ সালে নবম থেকে দ্বাদশ গ্রেডের ৫৪ শতাংশ আমেরিকান কিশোর-কিশোরী জানিয়েছিল যে, তাদের যৌন অভিজ্ঞাতা হয়েছে এবং ১৯ শতাংশ বলেছিল যে অন্তত ৪ জন পার্টনারের সঙ্গে তারা সেক্স করেছে। ২০১৫ সালে এদের সংখ্যা কমে যথাক্রমে ৪১ ও ১২ শতাংশে চলে আসে। একই সময় আমেরিকায় কিশোরীদের সন্তান জন্মদানের হারাও দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার প্রথম দিকেও এ্যালকোহলের পাশাপাশি সেক্স থেকে বিরত থাকার ঘটনা বাড়ছে। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের আমেরিকানরা জানিয়েছে যে, ১৮ বছর বয়স থেকে তাদের কোন যৌনসঙ্গী নেই। এদিক দিয়ে জাপান আরও এগিয়ে। ২০১৫ সালে ২০ থেকে ২৪ বছরের ৪৭ শতাংশ জাপানী অবিবাহিত পুরুষ জানায় যে, কখনও কোন মহিলার সঙ্গে তাদের সেক্স হয়নি। এমন পুরুষের সংখ্যা ২০০২ সালে ছিল ৩৪ শতাংশ। এসব পরিবর্তনের কারণ কি? এর এক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো পারিবারিক জীবন বদলে যাওয়া। ১১ দেশে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে বাবা-মায়েরা সন্তান পরিচর্যায় অধিকতর সময় ব্যয় করছে। আমেরিকায় গড় বাবা-মা ২০১২ সালে প্রধানত সন্তানদের দেখাশোনার পেছনে দিনের ৮৮ মিনিট সময় ব্যয় করেছিল। ১৯৬৫ সালে তারা ব্যয় করেছিল ৪১ মিনিট। মায়েদের তুলনায় বাবারা সন্তান পরিচর্যায় কম সময় দিলেও আনুপাতিক হিসেবে এ কাজে তাদের সময় ব্যয় করার পরিমাণ বেড়েছে। হল্যান্ডের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মদ্যপান না করার ব্যাপারে কিশোর-কিশোরীরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে অধিকতর চাপ অনুভব করে। হৈ-হুল্লোড় করে কিশোরদের মদ্যপান ২০০৩ সালের পর থেকে হ্রাস পাওয়ার এটাই সম্ভবত প্রধান কারণ। আরেক সম্ভাব্য কারণ, কিশোর ও তরুণদের মন স্কুল ও একাডেমিক কাজকর্মের ওপরই অধিকতর নিবিষ্ট থাকছে। যার ফলে তারা বাড়িতেই বেশিক্ষণ থাকছে। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ব্রাইটনের একটি যুব ক্লাবের মালিক জানান, ১০-১৫ বছর আগে তার ক্লাবগুলোর মতো ক্লাবগুলো স্কুল খোলা থাকার দিন রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকত। এখন রাত ১১টা খুব বেশি দেরি বলে মনে করা হয়। তারা লেখাপড়া ছাড়াও অন্যান্য দরকারি কাজকর্মেও নিয়োজিত হচ্ছে। এদিকে পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে তরুণদের কাজ করাও কমে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪৩ শতাংশ আমেরিকান জুলাই মাসে গ্রীষ্মের ছুটিতে কাজ করেছিল। এর দুই দশক আগে এই শ্রেণীর মার্কিন তরুণের সংখ্যা ছিল ৬৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে ১৬-১৯ বছর বয়সী আমেরিকান তরুণদের খ-কালীন কাজের পারিশ্রমিকের অঙ্ক ছিল ঘণ্টায় ৯.২০ ডলার। এই পারিশ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ার খরচ মেটানোর ব্যাপারে এতই তুচ্ছ যেÑ তারা এ ধরনের কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলে গ্রীষ্মে ছাত্রছাত্রীর কাজ করার হার যেমন কমছে তেমনি এর পাশাপাশি এই সময় তাদের পড়াশোনার হারও বাড়ছে। এ্যান হ্যাগেল নামে এক ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী তরুণদের আচরণগত পরিবর্তনের আরেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আজকের তরুণরা ক্রমবর্ধমান হারে, জাতিগতভাগে ভিন্ন। যেমন ব্রিটেনে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর আগমন ঘটেছে। এই অভিবাসীদের মদ্যপান, ধূমপান ও প্রাকবিবাহ যৌন মিলনের বিরুদ্ধে প্রবল ধরনের সংস্কার আছে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে আরও বেশি। হ্যাগেল বলেন, লন্ডনে কিশোরদের মধ্যে মধ্যপানের ঘটনা বিরলতম। বলাবাহুল্য লন্ডনে অভিবাসীদের ভিড় বেশি। পরিশেষে বলা যায় যে মানুষের আচরণ পরিবর্তনে প্রযুক্তিরও সম্ভবত ভূমিকা আছে। কিশোররা ইন্টারনেটে নেশাযুক্ত হয়ে পড়ছে। তারা স্মার্টফোন করায়ত্ত করার ফলে এই প্রবণতাটা আরও বেড়ে গেছে। ধনী বিশ্বের তথা ওইসিডি দেশগুলোর ১৫ বছরের ছেলেমেয়েরা ২০১৫ সালে সাপ্তাহিক রাতগুলোতে দৈনিক ১৪৬ মিনিট অনলাইনে ব্যয় করেছে যা ২০১২ সালের তুলনায় ১০৫ মিনিট বেশি। এক্ষেত্রে ধনী বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে চিলি। সেখানে উইকভেজগুলোয় তারা গড়ে ১৯৫ মিনিট এবং উইকত্রন্ডের দিনগুলোয় ২৩০ মিনিট অনলাইনে ব্যয় করে। সামাজিক মাধ্যমগুলো কিশোর সমাজকে তাদের সহকর্মী-বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রক্ষার তাড়না মেটানোর যেমন সুযোগ করে দেয় তেমনি এর পাশাপাশি বাবা-মায়েদেরও তাদের সন্তানদের ক্ষতিকর পদার্থ থেকে নিরাপদে ও দূরে সরিয়ে রাখার আকাক্সক্সক্ষাও কাজ করে। আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাবা-মায়ের অজান্তে ও অলক্ষ্যে কিশোর-কিশোরীদের ইচ্ছামতো যত্রতত্র ঘুরেফিরে বেড়ানো বেশ হ্রাস পেয়েছে। কিশোররা এখন অনলাইনের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। তাদের মধ্যে অনলাইনেই আড্ডা চলছে। গালিগালাজ, অপমান, নগ্ন ছবি বিনিময় সব অনলাইনেই হচ্ছে। তাও অন্তত ভাল এদিক দিয়ে যে তারা একসঙ্গে বসে মাদকদ্রব্য সেবন করছে না, মদ খাচ্ছে না, মারামারি করছে না, ভদকার বোতল ছোড়াছুড়ি করছে না। এই ডিজিটাল আদান-প্রদানের মাশুল যে দিতে হচ্ছে না তা নয়। হার্ভাডের এক মনোবিজ্ঞানী সোফি ওয়াসন বলেছেন, কিছু কিশোর-কিশোরী মুখোমুখি যোগাযোগের বিকল্প হিসেবে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে। তা করতে গিয়ে তারা বন্ধুদের সঙ্গে গভীর আবেগগত যোগাযোগের কিছু সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলে। মিজ ওয়াসন মনে করেন যে, এভাবে সামাজিক মাধ্যম কিশোররা নিজেদের সম্পর্কে কিভাবে এবং তাদের সম্পর্কে বন্ধুদের প্রত্যশাই বা কী বলে তারা মনে করে এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়। তবে প্রযুক্তি নজরদারির সুযোগও বাড়িয়ে দেয়। বাবা-মায়েরা সন্তান কোথায় আছে কি করছে জানার জন্য প্রায়শই তাদের ফোন ও ট্যাক্সি ট্র্যাক করে থাকে। কিশোররা বেশি। টেক্সট করছে কিংবা কম্পিউটার গেম বেশি খেলছে। এই নিয়ে উদ্বেগের কারণে বাবা-মায়ের মনে, স্মার্টফোন ও কম্পিউটার নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর পরিণতি ভাল হোক, মন্দ হোকÑ যাই হোক কিশোর-কিশোরীরা আজ অতীতের তুলনায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এক জরিপে দেখা যায়, ১৫ বছর বয়সের যেসব ছেলেমেয়ে বলে যে স্কুলে তারা সহজেই বন্ধু জুটিয়ে নিতে পারে তাদের সংখ্যা প্রায় প্রতিটি দেশেই কমছে। এদিক দিয়ে পাশ্চাত্যের কোন কোন দেশকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেখতে লাগে। তাদের সঙ্গে এখনকার কিশোরদের পার্থক্য হলো আজকের কিশোর-কিশোরীরা অনেক কিছুতেই মন্থর। তারা পান করতে, সেক্স করতে টাকা আয় করতে মন্থরতার পরিচয় দেয়। সম্ভবত তারা গৃহত্যাগ করতে, বিবাহ করতে ও সন্তান উৎপাদন করতেও মন্থরতার পরিচয় দেবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×