ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

প্রসঙ্গ ॥ প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য পুরস্কার। ছি.!

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

প্রসঙ্গ ॥ প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য পুরস্কার। ছি.!

বছর দুই আগে, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশ স্টলে অনেকেই উপস্থিত। প্রত্যেকে বাঙালী। কেউ পশ্চিমবঙ্গের কেউ বাংলাদেশের। নানা গল্প। আড্ডা। শীতের পোশাক থেকে ফ্যাশন। সমকাম থেকে উদ্বাস্তু, বই থেকে বউ। আড্ডার ফাঁকফোকরে যা হয়, প্রেম ভালবাসা-বিচ্ছেদ, লেখকের মর্যাদা, ভাঁড়ামো, দাম্ভিকতা, ‘নিজে কী হলেম রে’, ইত্যাদি-কথা। একজন, হাইডেলবার্গের বাসিন্দা, হঠাৎই বিস্ময় প্রকাশ করেন- “আচ্ছা, অমুক কী লেখক? বাংলাও সঠিক লিখতে জানে না, কী করে ‘ওই’ প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পেল? মাচার তলার রহস্য কী?” চটপট উত্তর শোনা গেল, কথক, রাজনীতিক-প্রকাশক-লেখকও। বাংলাদেশে মান্য তিনি। বহু খ্যাতনামার বইও মুদ্রণ করেছেন। বললেন, ‘কয়টি সাহিত্য পুরস্কার? কোন কোন শাখায়? লেখক হওয়ার দরকার নেই। প্রতিবছরই পুরস্কার পাবেন। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-নাটক-গবেষণা-শিশু সাহিত্য-অনুবাদে। তবে গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে। বিচারকদের নিয়মিত খাওয়াতে হবে, পার্টি দিতে হবে, দামী দামী উপহার দিতে হবে। এমন কী মদের বোতলও। বিদেশে ভ্রমণ, থাকা-খাওয়া খরচাপাতিও দিতে হবে। সেই সঙ্গে চাটুকারিতা, নিত্যবেলায় তৈলমর্দন। তাও যদি না পারেন, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীকে ধরতে হবে। বলতে হবে আজ বাদে কাল মারা যাব। এই দেখুন বুকের এক্স-রে প্লেট, ডাক্তারের সার্টিফিকেট। আর হ্যাঁ, সচিব পর্যায়ের আমলা হন যদি, গদ্যপদ্য, লেখেন, সাহিত্যের পদবাচ্য না হোক, ওই প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দিতে বাধ্য। লাজলজ্জা নেই। খুঁটির জোর, তোষামুদি, ধরাধরি, টাকাপয়সা বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম শর্ত। এত গুণাবলী যদি না থাকে, সমালোচনা করে লাভ কী।’ কার-কার ছিল বা আছে, কে কে পুরস্কৃত, নাতিদীর্ঘ তালিকা শোনা গেল আরেকজন প্রকাশকের কণ্ঠে। কলকাতার মিনিবাসের গায়ে এক সময় বড়-বড় আখরে লেখা থাকত : ‘দেখলে হবে? খরচা আছে।’ ইদানীংকালে সাহিত্য পুরস্কার পেতে চান, খরচ করবেন না? তাই কী হয়? অমুক প্রতিষ্ঠানের সাহিত্যের যারা বিচারক, প্রধান বিচারক, বিচারকের সঙ্গে একই ছাউনিতে যারা (জুরি বোর্ডে), গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল এদের অধিকাংশ না জানে লিখতে গদ্য, না জানে পদ্য। তাদেরই বিচার কে করে ঠিক নেই। তারা হন বিচারক। কোন চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ এখানে নয়। সব প্রতিষ্ঠানেই ‘চলছে রসের খেলা’। সাহিত্যের মান কোন রসাতলে, সহজেই অনুমেয়। কমলকুমার মজুমদারের মতো ডাকসাইটে লেখক সম্পর্কে গুঞ্জরন, ‘গুরুগম্ভীর, অল্পকথার মানুষ, কাঠখোট্টা, সমালোচনায় চাঁছাছোলা। কাউকে তোয়াজ করেন না। অমিশুক।’ ঠিক নয় এই প্রোপাগা-া। যাঁদের পছন্দ করেন, হোক সম-অসম বয়সের, ইয়ার আড্ডায় মাতেন, রঙ্গরসিকতায় দিলখোলা। রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা উদ্ধৃত করে মাঝে-মধ্যে তীক্ষè শ্লেষ, ফোঁড়নও কাটেন। ওঁর এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করেন, ‘অমুক তরুণ লেখকের নাম শুনেছেন?’ উত্তর : ‘আকাশে পাতিয়া কান।’ সহকর্মীর প্রশ্ন : ‘সত্যজিতের ওই ছবি হিট, দেখেছেন? জবাব : ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া।’ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষক কবি শুভ মুখোপাধ্যায় গদমদ কণ্ঠে কমলকুমারকে সুসংবাদ জানান, অমুক (লেখক) পুরস্কার পেয়েছেন। কমলকুমারের ভাবলেশহীন প্রতিক্রিয়া, বয়ান : ‘মাঠে একাই দৌড়ুচ্ছিল, আয়োজকরা বাকিদের পেঁদিয়ে বিদেয় করেছে। পাছে অন্য কেউ পায়।’ সাহিত্যে পুরস্কার নিয়ে, এমন কী নোবেল পুরস্কার (সাহিত্য) নিয়েও নানা কানকথা, মুখরোচক খোশ গপ্পো। কলকাতায় বহুল প্রচলিত একটি কথা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন বিধানচন্দ্র রায়। দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী। কানে খাটো। সবটা না শুনে নাকি, মাঝে মধ্যে উল্টোপাল্টাও রায় দেবেন। অনেকেই রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন। তারাশঙ্কার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। মনের দুঃখে, ক্ষোভে বিধানবাবুর খাস দরবারে গেছেন। আবদার করতে। পুরোটা না শুনে সচিবকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, ‘তারাচন্দ্র শেখরবাবু কী চাইতে এসেছেন, তোমার ঘরে কিংবা রাইটার্স বিল্ডিং-এ থাকলে দিয়ে দাও। আমার পক্ষ থেকে।’ পরের বছর রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন তারাশঙ্কর (এই গল্পের রসিক কথক কবি তারাপদ রায়)। পরশুরাম-এর একটি গল্পের নাম ‘উৎকোচ তত্ত্ব।’ বলা হচ্ছে গল্পে, ‘ঘুষগ্রাহী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই বুঝতে পারে না যে সে ঘুষ নিচ্ছে। পাপ সব সময় স্থূলরূপে দৃষ্টিগোচর হয় না, অনেক সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে দেখা দেয়, তখন তার স্বরূপ চেনা বড়ই কঠিন। স্পষ্ট ঘুষ, প্রচ্ছন্ন ঘুষ আর নিষ্কাম উপহার- এদের প্রভেদ নির্ণয় সকল ক্ষেত্রে করা যায় না। ... এছাড়া বাক্সময় ঘুষ আছে যার আর্থিক মূল্য নেই, অর্থাৎ খোশামোদ বা প্রশংসা। নিপুণভাবে প্রয়োগ করলে বুদ্ধিমান সাধুলোকও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।’ পরশুরাম বলছেন ‘বুদ্ধিমান’। তথা বুদ্ধিজীবী। ‘সাধুলোক’ মূলত বহিরঙ্গে। আদতে বুদ্ধিমান/সাধুলোক চূড়ান্ত ভ-। বিস্তর প্রমাণ। যারা প্রাতিষ্ঠানে পুরস্কারের চেয়ারে আসীন, আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিমান/ সাধুলোক, বিচারক, আসলে প্রচ্ছন্ন ঘুষখোর। নিজেরাই নিজেদের মানসম্মান নষ্ট করেছেন। লজ্জাহীন অবশ্যই। বেশি কথা বলবেন না। সাফাই গাইবেন না। হাটে হাঁড়ি ভাঙলে সবকিছু গুবলেট হবে। কোন খোশামদে, ঘুষে, প্রচ্ছন্ন ঘুষে এরা পদাধিকারী? সাহিত্যের বিচারক? পুরস্কারদাতা? অবাক মানি আরজ আলী মাতুব্বর পুরস্কৃত নন। দর্শনধারী বলে? সার্ত্রে, রাসেল, দার্শনিক। কেন ‘সাহিত্যে’ নোবেল পুরস্কার পান? সার্ত্রে না হয় দুটি নাটক লিখেছেন। ইতিহাসবিদ সোমসেন কেন পান? হায়াৎ সাইফ (সাইফুল ইসলাম খান), কবি। ফারুক আলমগীর, আসাদ মান্নান, মাহবুব খান বুলবুল পান না। প্রবন্ধে হাসান ফেরদৌস অনুবাদে হায়দার আলি খান পান না। আরও উদাহরণ আছে। তালিকা দীর্ঘ। প্রচ্ছন্ন ঘুষ। তৈলমর্দনে নিশ্চয় সিদ্ধহস্ত নন এঁরা। বাংলাদেশের সাহিত্য পুরস্কার (প্রাতিষ্ঠানিক) এখন রাজনৈতিক, ক্ষমতার, দলাদলির। এই করে দেশের সাহিত্যের সোপান তৈরি? -একটিই শব্দ ‘ছি!’ ৩০ জানুয়ারি ২০১৮, বার্লিন, জার্মানি
×