ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বাঙালী ব্যবসায়ীর পণ্য যখন বই

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

বাঙালী ব্যবসায়ীর পণ্য যখন বই

ব্রিটিশ বণিক এবং শাসক বাঙালীদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সুযোগ গলাটিপে হত্যা করেছিল। ভারতের বোম্বাই, মাদ্রাজ ইত্যাদি শহর যখন দ্রুত গতিতে বাণিজ্যে এগোচ্ছে বাংলা তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিতে শেকড় গেড়ে অনড় বসে আছে। জমিদার শ্রেণীর হাতে যে পুঁজি জমেছিল তা তারা ভূসম্পত্তি বাড়াতেই ব্যয় করেছে, ব্যবসা বা শিল্প বিনিয়োগে নয়। সে সুযোগ যে পরিকল্পিতভাবেই সঙ্কুচিত করে রেখেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক লর্ড কর্নওয়ালিস ও তাঁর সহযোগীরা তা বোঝা যায় কর্নওয়ালিসের বক্তব্য থেকেইÑ ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এ দেশের ভূস্বামীদের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্ত মনে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করতে পারে তাঁর মনে এর কোনরকম পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না’ (বিনয় ঘোষ)। বিনয় ঘোষের ‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন- ‘ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে সেটাকে তারা অন্য কোনভাবে নিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে।’ এ কাজ সহজ করতে এবং ব্যবসা ও শিল্প খাতে পুঁজি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে ইংরেজ সরকার আইন প্রণয়নসহ গোটা পরিবেশই প্রতিকূল করে রেখেছিল। পাশাপাশি উন্মুক্ত রেখেছিল ভূমিস্বত্ব কেনার সহজ ব্যবস্থা। বাঙালী স্বভাবত তাই মাটির দিকেই ঝুঁকেছে। ইংরেজের সঙ্গে শিল্প-ব্যবসা বিনিময়ে নিজ দেশে ইংরেজ হয়েছে শিল্প পুঁজিপতি আর বাঙালী দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রিন্স উপাধি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জমিদারীর গ-িতেই আটকে থাকেন, দেশীয় শিল্প বিকাশে অবদান রাখতে পারেন না। আজও ব্যবসায়ী হিসেবে বাঙালী তেমন সুনাম কুড়াতে পারেনি। আর দশটা পণ্য নিয়ে বাঙালী ব্যবসায়ী যেখানে পুরোপুরি পেশাদার হতে পারে না সেখানে বই ব্যবসায় পেশাদার হওয়াও কঠিন। তবু দেশের প্রকাশনা জগত আজ অনেক দূর এগিয়েছে। ‘প্রকাশনা শিল্প’ কথাটা উচ্চারিত হচ্ছে। এর পেছনে অমর একুশে বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পের গতি দ্রুত বাড়িয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ ও ঝামেলা অনেক কমেছে। খুব অল্প সময়ে বাজারজাত করা যায় বলে প্রচুর বই বাজারে আসছে। প্রকাশনার মান বেড়েছে, প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণেরা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে পুরো মাত্রায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক লাফে একে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে বারবার সেই চেনা প্রশ্নটি উঠেছেÑ বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশ কাটিয়ে প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগামী যাত্রা নিশ্চিত করেছে যে, বই হারাবে না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বই সাংঘর্ষিক নয়। বরং এর ব্যবহার বইয়ের উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। বই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের পেশাদার হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। লেখার এবং কেনার প্রবণতাও বাড়িয়েছে। যে কেউ যে কোন বিষয় নিয়ে লিখছে। রান্না, রূপচর্চা, ফ্যাশন, লাইফস্টাইলÑ সব কিছু নিয়ে বই হচ্ছে। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়ারও দুটো কবিতা কিংবা গল্পের বই, গৃহবধূর দু’খানা লাইফস্টাইল বা রান্নাবিষয়ক বই, চাকরিজীবীর গদ্য-পদ্য মিলিয়ে হাফ ডজন বই থাকা আজকাল প্রায় স্বাভাবিক। কিছু লিখলেই তা নিখুঁত বই হয়ে আসছে সহজে। এই বিপুলসংখ্যক বই চিন্তা বা মননশীলতার জগতে কি অবদান রাখছেÑ তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রকাশনা শিল্প এগুচ্ছে। যার অর্থ বই ব্যবসা লাভজনক পণ্যে পরিণত হচ্ছে। বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যান মতে, দু’হাজার ষোলয় একুশের বইমেলায় নতুন বই এসেছিল প্রায় চার হাজার আর বিক্রি হয়েছিল ২৬ কোটি টাকার। ক্রেতা-পাঠকের উপস্থিতিও নাকি ছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মাসজুড়ে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের আগমন হয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। একাডেমির জরিপে বেরিয়ে এসেছেÑ ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমিরই বিক্রি হয়েছে ৮২ লাখ ৫৩ হাজার টাকার বই। আগের বছর এ হার ছিল ৭২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। সে বছর বই এসেছিল ৩ হাজার ১৩টি। এবারের মেলায় ৪ হাজারের বেশি বই আসার সম্ভবনা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি দুই-ই বাড়ছে। একুশের বইমেলা মূলত এখন ‘প্রকাশকদেরই মেলা।’ প্রকাশকদেরই বাইরে এখন স্টল বরাদ্দ প্রায় দেয়াই হয় না। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র নীতিমালা মেনে মেলা পরিচালিত হচ্ছে। উটকো প্রকাশক, সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বই বিক্রির হিড়িক কমেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বইমেলা হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ও প্রকাশকদের মেলা। প্রায় পঁাঁচ শ’ বছরের পুরনো এ আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম তিন দিন বরাদ্দ প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের জন্য। এ তিন দিন অন্য কারও মেলায় প্রবেশ নিষেধ। চার বছর আগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এ মেলায় চার লাখের মতো বই এসেছিল। অংশ নেয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩১৪টি। এসব পরিসংখ্যান বইয়ের অগ্রগামী অভিযাত্রার চিত্রই তুলে ধরে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকাশনা শিল্প যত দৃঢ় হচ্ছে, ভাল লেখকের ঘাটতি ততই প্রকট হচ্ছে। দায়িত্বশীল প্রকাশকদের সহযোগিতায় অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেনÑ এমন দৃষ্টান্ত পশ্চিম বাংলায় অনেক আছে। ব্যবসার ক্ষতি না করেও এটা করা যায়। আমাদের এখানে একজন লেখক বাজার পেয়ে গেলে তাকে নিয়ে কর্পোরেট বাণিজ্য পাপড়ি মেলতে থাকে। প্রতিশ্রুতিশীল বা ক্ষমতাবান অন্য লেখকরা পাত্তা পান না। এ ধরনের মানসিকতা ভাষা-সাহিত্যের বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। কলকাতার দায়িত্বশীল প্রকাশনী ‘প্রতিক্ষণ’-এর কর্ণধার প্রিয়ব্রত দেব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেনÑ ‘প্রকাশকদের কাজ শুধু বই প্রকাশ আর বেচা নয়। পাঠক তৈরি করাও তাঁদের দায়িত্ব। নতুন লেখক তৈরিতে মন দেয়া প্রয়োজন। প্রকাশনা একটি সম্ভ্রান্ত ব্যবসা। প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। বই মানব সভ্যতার অগ্রগতির ঐতিহাসিক দলিল। তাই পাঠককে উন্নততর রুচির সন্ধান দেয়া প্রয়োজন।’ বাণিজ্যিকে উপেক্ষা না করেও এ কমিটমেন্ট পালন করা যায়। কমিটমেন্ট পেশাদারিত্বের অংশ। পৃথিবীর সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। একই ভাষা গোষ্ঠীর ফরাসী বা জার্মান ভাষীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও নিজেদের ভাষায় জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। পৃথিবীতে এখন ফরাসী ভাষায় কথা বলছে ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। জার্মান ভাষায় ৯ কোটি আর বাংলায় কথা বলছে ১৮ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ। পরিসংখ্যানেই কেবল বাংলা, ফারাসী ও জার্মানের দ্বিগুণ বা তার বেশি এগিয়ে আছে। কাজেকর্মে পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর। ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিতা এর অন্যতম কারণ। আমাদের পুঁজির শক্তি নেই। ভাষার কণ্ঠও তাই ক্ষীণ। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারত ও চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের ছিল। কিন্তু চীনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ঢুকতে না পারায় আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তাদের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোও। আর আমরা আজও রাজনীতি অর্থনীতির সবকিছুতে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-সাহিত্যেও পড়েছে। এ থেকে বেরোতে শিক্ষা-দীক্ষা আত্মমর্যাদার বোধ বাড়াতে হবে। আর এর সঙ্গে ভাষা-সাহিত্য বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যকে যাঁরা ছাপার অক্ষরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন তাঁরা ব্যবসায়ে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের গুরুত্বও বুঝবেন এমন সঙ্গত আশা করাই যায়।
×