ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদক ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে রাখিলের সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

মাদক ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে রাখিলের সংগ্রাম

নরসিংদীর বেলাবো থানার একটি সংগঠন এখন পর্যন্ত ৩১টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি রাখিল খন্দকার নিশান ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন গড়ে তুলেছেন দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক মাদকবিরোধী ফোরামের। কাজ করছেন সরাসরি টিআইবির ইয়েস এর সঙ্গে। রাখিল খন্দকার অর্জন করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের অধীনে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে সেরা সদস্য পুরস্কার। আজকের ডিপ্রজন্মে থাকছে সমাজের প্রচলিত ধারার বাইরের সফল তরুণ রাখিল খন্দকার নিশানের সাক্ষাতকার। নিয়েছেন- বেনজির আবরার ডিপ্রজন্ম : রাখিল খন্দকার নিশান সম্পর্কে জানতে চাই- রাখিল খন্দকার : আমার কথা বলতে গেলে, আমি একজন সাধারণ সমাজকর্মী। নিজের জায়গা থেকে বাল্যবিয়ে, মাদক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করছি। বাড়ি নরসিংদী জেলায়। বেলাবো থানার উয়ারী বটেশ্বরের পাশেই। দাদা মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন, আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বাবা সরকারী চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। বড় ভাই সরকারী চাকরি করেন আর বোন নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। স্কুল রাজারবাগ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এখান থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা আর এসএসসির গ-ি পেরিয়ে জেলা শহরের নরসিংদী সায়েন্স কলেজ থেকে এইচএসসি সমাপ্ত করে ঢাকায় এসে স্নাতকে ভর্তি হওয়া। ডিপ্রজন্ম : সংগঠন প্রতিষ্ঠার গল্প- রাখিল খন্দকার : এটা প্রতিষ্ঠার পেছনে একটা বড় গল্প রয়েছে। মূলত আমরা যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, আমাদের স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর এক মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। আমরা বিষয়টাতে খুব অবাক হই, যে মেয়ে এখনও বাচ্চা তার কিভাবে বিয়ে-সংসার হবে! আমরা প্রতিবাদ করলাম, তা ধোপে টিকেনি। পরবর্তীতে আমরা যার সঙ্গে বিয়ে তাকে নিজেদের সাধ্যমতো বোঝাতে চেষ্টা করলাম, কোন লাভ হলো না। হাল ছাড়ার পাত্র ছিলাম না আমরা, গেলাম ইউপি অফিসে। সেখানেও তেমন কোন আশার কথা না শুনে গেলাম থানায়। সবচেয়ে বিব্রতকর পরিবেশটা সেখানেই হয়, থানার এক কর্মকর্তা বলেনÑ ‘তোমাদের কারও সঙ্গে প্রেম আছে নাকি মেয়েটার, এত বাঁধা দিচ্ছো কেন?’ প্রতিবাদ করেছিলাম সেদিন ইচ্ছামতো তর্ক করে এসেছিল থানায়, এরপর হাজির হলাম থানার সর্বোচ্চ প্রশাসনে ‘ইউএনও’ অফিসে। তখনকার ইউএনও মেম মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন আর পরামর্শ দিলেন, ‘তোমরা একটা সংগঠনের ব্যানারে আসলে বেশি সহযোগিতা পাবে যে কোন জায়গা থেকে।’ বিয়েটা ভাঙ্গার ব্যাপারে তখন পর্যন্ত কোন আশা না পেয়ে খুব মন খারাপ হয় আমার আর বন্ধুদের। একসময় বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটার এখন তার দুটো বাচ্চা। মাঝে মধ্যে দেখা হয়, খুব খারাপ লাগে এত ছোট একটি মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে। আমি বন্ধুদের প্রস্তাব দিলাম, ‘চলো এ রকম একটা সংগঠন করি।’ সবাই সাড়া দিল, পরে এসএসসির বন্ধের তিন মাসে স্কুলের মাঠে বসে কাজ শুরু করলাম, কলেজ জেলা শহরে হওয়ায় সবাই যখন আসি গ্রামে তখন মানে প্রতি শুক্রবার বিকেলে মিটিং হতো। মূলত, এভাবেই দশম শ্রেণীর তরুণদের মাধ্যমে জন্ম নেয় তরুণ উদীয়মান সামাজিক সংগঠন। বর্তমানে ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে অফিস দিয়েছি আমরা, নিয়মিত বাল্যবিয়ে বিরোধী ও সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করে থাকি। জানলে খুশি হবেন, এরপর থেকে ৩১টা বাল্যবিয়ে সরাসরি ভেঙ্গেছি আমরা। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আজ আমি সাত বছর সময় ধরে সভাপতির দায়িত্বেও আছি। সব কৃতিত্ব আমার বন্ধুদের। ডিপ্রজন্ম : দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক মাদকবিরোধী ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা আপনি। সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত যেভাবে? রাখিল খন্দকার : আমার স্নাতকটা শেষ করেছি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে, বর্তমানে এখানেই ইংরেজী বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। ২০১৩ এর দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সঙ্গে আমরা ছোটখাটো কাজ শুরু করি, তাদের বিভিন্ন আয়োজনে আমাদের অংশ নিতে বলে। আমিও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন, তাই আগ্রহ ছিল অনেক। তৎকালীন ডিজি মহোদয়কে নিয়ে আমরা একটি কনসার্ট করি স্টামফোর্ডে, এরপর ভাবলাম আমাদের ক্যাম্পাসে একটা প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার মাদকের বিরুদ্ধে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ওয়েবসাইট ঘেঁটে পেলাম একটা তথ্য- দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ফোরাম নেই। মানে আমরা করলে সেটি হবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম মাদকবিরোধী ফোরাম। যেই ভাবা সেই কাজ। সবার সহযোগিতায় গত বছরের ২৪ মে আমি প্রতিষ্টা করি ‘স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরাম’। বর্তমানে সংগঠনটির কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করছি। মাদকের ছোবল থেকে তারুণ্যকে বাঁচাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা মাদকবিরোধী আয়োজন করছি নিয়মিত। গত বছর এমন এক আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন অধিদফতরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ডিজি স্যার, তিনি সবসময় আমাদের পাশে থাকার ঘোষণা দেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাষ্ট্রীয় আয়োজনটির পুরো স্বেচ্ছাসেবী সমর্থন দিয়েছি আমরা, অধিদফতরের হাসপাতাল শয্যা বাড়ানোর আয়োজনে আমাদের ভূমিকা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন। এরমাঝে সরকারী এ প্রতিষ্ঠানটির বইমেলার স্টল, কর মেলার স্টলেও সর্বাত্মক সহযোগিতায় ছিলাম আমরা। ছোটবড় আয়োজনে মাদকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্টামফোর্ড থেকে শুরু করতে পেরে আমর গর্বিত, পরবর্তীতে নর্থ সাউথসহ আরও ভার্সিটিগুলোতে ফোরামটি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ডিপ্রজন্ম : আপনি মানুষ হিসেবে এতগুলো সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকে যা পেয়েছেন? রাখিল খন্দকার : আপনি জেনে খুশি হবেন, আমি টিআইবি পরিচালিত ‘ইয়েস’ গ্রুপের স্টামফোর্ড ইউনিটের লিডার হিসেবেও কাজ করছি। আমার কাজগুলো দুর্নীতি, মাদক, বাল্যবিয়ে রোধে। আমি মানুষ হিসেবে একসঙ্গে তিনটা প্ল্যাটফর্মে থেকে বুঝেছি, ভাল কাজের সঙ্গে থাকলে মানুষের মধ্যে যে সম্মান পাওয়া যায় আর কোথাও এটা সম্ভব না। ডিপ্রজন্ম : এ পর্যন্ত পাওয়া বড় স্বীকৃতিগুলো- রাখিল খন্দকার : আমি স্বীকৃতির চেয়ে কাজে বিশ্বাসী। আমি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমোদিত সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো ‘সেরা সদস্য’ নির্বাচিত হই, টিআইবি কর্তৃক দেশসেরা ইয়েস পদক পাই, ইউআইইউতে মাদকবিরোধী নাটক প্রতিযোগিতায় ৩য় হই। এ অর্জনগুলোকে আমার কাজে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ডিপ্রজন্ম : তরুণদের বিপথগামী হওয়ার এই সময়ে এত ব্যতিক্রমী কাজ করে যে আগামী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন? রাখিল খন্দকার : তরুণরা বিপথে এটা মানতে নারাজ আমি। কাজ করার সুযোগ আর ভাল কাজ বেশি হলে সবকিছুই সম্ভব, ব্যতিক্রমী কাজের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের তরুণদের বড় একটি অংশ। আগামীর বাংলাদেশে তরুণরা আরও সচেতন হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, স্বপ্ন দেখি মাদক- দুর্নীতি- বাল্যবিয়ে মুক্ত একটি বাংলাদেশ। ডিপ্রজন্ম : যারা পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজ সচেতনামূলক কাজে আসতে চায়, ডিপ্রজন্মের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন রাখিল খন্দকার : আসলে এখন সময়টা তাল মিলিয়ে চলার। শিক্ষাজীবনে আমার ফলাফল অনেক ভাল ছিল পুরোটা সময়েই, কিন্তু এরমাঝেই সব করছি। যতদিন আছি, কাজ করব পুরো মনোযোগ দিয়ে। এরপর চেষ্টা করব দেশের উপকারে কাজ করার। পরামর্শ থাকবে একটাই ‘জীবনটাকে কেবল বইতে বেঁধে রাখবেন না। নতুন পরিবেশে গেলে খুঁজুন এখানে কি আছে কি নেই, সবাই অন্তত একটি করে সামাজিক সংগঠনে কাজ করুন।’
×