ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে আলোচনা

নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা অসাংবিধানিক তৃতীয় শক্তির উত্থান চেয়েছিলেন

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা অসাংবিধানিক তৃতীয় শক্তির উত্থান চেয়েছিলেন

সংসদ রিপোর্টার ॥ চলমান দশম জাতীয় সংসদে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ‘অধিক কার্যকর ও প্রাণবন্ত’ দাবি করে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সংসদ গঠিত না হলে দেশে গণতন্ত্র থাকতো না, অসাংবিধানিক সরকার আসতো। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের দিয়ে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে হত্যা করে তৃতীয় শক্তির অসাংবিধানিক সরকার আনতে চেয়েছিলেন, আরেকটি ওয়ান ইলেভেন সৃষ্টির চক্রান্ত করেছিলেন। কিন্তু দেশের জনগণ বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল নাশকতা- অগ্নিসন্ত্রাসকে মোকাবেলা করে নির্বাচনে ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি গত নির্বাচনী ট্রেন ফেল করেছে, আগামী ট্রেন মিস করলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যই অন্ধকার নিমজ্জিত হবে, বিএনপির অবস্থা মুসলিম লীগের থেকেও খারাপ হবে। ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সোমবার সন্ধ্যায় সংসদ অধিবেশনে বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের চতুর্থ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এক অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন। আলোচনার সূত্রপাত করেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। আলোচনায় অংশ নেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভা-ারী, বিএনএফের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ, বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও কাজী ফিরোজ রশীদ। আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে দেশে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতো। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা দিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল, উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে গেছি। অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের থেকেও এগিয়ে। তিনি বলেন, বিএনপি ও খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু খালেদা প্রত্যাখ্যান করেছেন, আলোচনায় আসেনি। এমনকি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী গুলশানের বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে দেখা করেননি খালেদা জিয়া। তাঁরাই এখন সংলাপের কথা বলেন কোন মুখে? তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, দশম জাতীয় সংসদ সবদিক থেকে সফলতা অর্জন করেছে। গালিগালাজ, অসাংবিধানিক কথা বলা, অশালীন বক্তব্য মানেই সংসদ নয়। অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়েছে এই সংসদে। যারা বর্তমান সংসদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তারাই (ড. কামাল হোসেন) অতীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সিপিএ ও আইপিইউ নির্বাচনে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করে সারাবিশ্বই বর্তমান সংসদকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল বলেই দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে, দেশ উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন নির্বাচন না হলে তৃতীয় কোন শক্তি এসে গণতন্ত্রকে হত্যা করতো। নির্বাচন বানচাল করতে খালেদা জিয়া জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। গণতন্ত্রের পূর্বশর্তই হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গী তৎপরতা চালিয়েছিল। তারা চেয়েছিল দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে ধ্বংস করে অসাংবিধানিক সরকার কায়েম করতে, আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু দেশের জনগণ তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। নির্বাচনে কে আসলো, কে আসলো না- এটা রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। বিএনপি একবার ট্রেন মিস করেছে, আগামী নির্বাচনের ট্রেন ফেল করলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছি। জ্বালাও-পোড়াও ও ভয়াল নাশকতার মধ্যেও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে তারা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। ট্রেন ফেল করেছেন, পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করুন। নির্বাচন বানচালের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে। সম্মিলিতভাবে তাদের বাধা দিতে না পারলে আবারও জ্বালাও-পোড়াও ঘটাবে। এই সুযোগ কোনভাবেই তাদের দিতে হবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কিছু বুদ্ধিজীবী বলেছিল এই সংসদ নাকি ৩ মাসও টিকবে না। চার বছর পূর্তি হয়েছে, ইনশাল্লাহ বর্তমান সংসদ ৫ বছরই পূর্ণ করবে। জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে দেশবাসীর সামনে প্রশ্ন উঠেছিল দেশে গণতান্ত্রিক ধারা থাকবে কি না। দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে কি না। নির্বাচন না হলে দেশে কী হতো? দেশের ওই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচনে যেতেই হবে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নিলে দেশে গণতন্ত্র থাকতো না, অসাংবিধানিক সরকার আসতো, দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখন অনেকেই হুমকি দেন কেউ জেলে গেলে নির্বাচন হবে না। কিন্তু ’৯১-এর নির্বাচনে এইচ এম এরশাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তখন কী তাদের (বিএনপি) এসব কথা মনে ছিল না। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই মিথ্যা মামলায় এরশাদকে ৬ বছর জেল খাটতে হয়েছে।। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদকে অকার্যকর করেনি, বরং ’৯১ সালের পর থেকে এই প্রথম দশম জাতীয় সংসদ কার্যকর ও প্রান্তবন্ত ছিল। সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এখন পস্তাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন ব্যতীত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার কোন বিকল্প পথ নেই। বিএনপি এখন ৮ ফেব্রুয়ারির ভয় দেখাচ্ছে। দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তিও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে- এটা আদালতের ব্যাপার। নির্বাচনে আসা সকলের দায়িত্ব। কিন্তু বিএনপি আদালতকে ভয় দেখাতে বলছে খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে দেশে নাকি আগুন জ্বলবে। এমন হুমকি হাস্যকর, অলীক কল্পনা। দেশের জনগণ কোনদিনই বিএনপিকে সেই সুযোগ দেবে না। অনির্ধারিত আলোচনার সূত্রপাত্র করে সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, নিন্দুকেরা বর্তমান এই সংসদ নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না করতেন তবে গণতন্ত্রের বদলে দেশে অসাংবিধানিক সরকার আসতো। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে, ছিল এবং থাকবে। এটা বুঝতে পেরেই সারাবিশ্বের নির্বাচিত এমপিরা ভোট দিয়ে বিশ্বের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংসদীয় সংস্থা আইপিইউ ও সিপিএতে বাংলাদেশের দুই প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন। এই দুটি শীর্ষ সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত করে বাংলাদেশ সারাবিশ্বের সামনে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিমত্তার জানান দিয়েছে। সংসদ বর্জনের রাজনীতিও এখন আর নেই। বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, গণতন্ত্রের মূল শক্তিই হচ্ছে জাতীয় সংসদ। যে দেশের গণতন্ত্রের ভীত যত শক্ত, সেদেশের সংসদ ততবেশি কার্যকর ও প্রাণবন্ত। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় দশম জাতীয় সংসদ একমাত্র সফল ও কার্যকর সংসদ। কারণ অতীতে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তখন বিরোধী দল সংসদ বর্জন করেছে। কিন্তু এই সংসদে বিরোধী দল সংসদে থেকেই সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিল। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় হবে। আদালত কী রায় দেবে জানি না। তবে এই রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত জোট নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানী আইএসআই, মোসাহেদসহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের অনেক অর্জন আছে, আবার কিছু দুর্বলতাও আছে। সংসদের চার বছর হয়ে গেল কিন্তু জয়বাংলা হিসেবে জাতীয় স্লোগান এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে পারিনি। একাদশ জাতীয় নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য বিএনএফ তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে। কোথাও কাউকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে দেবে না।
×