ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি জামায়াতের জ্বালাও পোড়াও;###;নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ

মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারে শম্বুকগতি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারে শম্বুকগতি

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দেশব্যাপী হরতাল অবরোধের নামে পেট্রোলবোমা, বোমা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামিদের অবস্থা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। চার বছর আগের দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে অর্ধেক মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। অনেক আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে বের হয়ে গেছে। আবার অনেক আসামি এখনও গ্রেফতার হয়নি, পলাতক থেকে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এসব মামলার ঘটনার হোতাদের অনেকেই। চার বছর আগের খুন, নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির সহিংস ঘটনাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের জন্য নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে নির্বাচনপূর্ব থেকে ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা পেট্রোলবোমা ও নাশকতার ঘটনায় দেশব্যাপী মামলা দায়ের করা হয় দুই সহস্রাধিক। এর মধ্যে পেট্রোলবোমা হামলা, অগ্নিসযোগ, নাশকতাসহ সহিংসতার ঘটনায় প্রায় ১ হাজার মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। চার বছর আগে ২০১৩ সালের এবং ২০১৫ সালের বিএনপি-জামাত জোটের ডাকা সারাদেশের টানা হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও সংঘটিত নাশকতা মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা চলছে অত্যন্ত শম্বুক গতিতে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নাশকতার ঘটনাগুলোর মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে গাড়িতে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে। চারবছর আগের নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির সহিংস ঘটনাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা শেষ না হতেই আবারও সহিংস রাজনীতির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার প্রেক্ষিতে পুরনো মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি ধরার বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ সদর দফতর। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালের শেষভাগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন হরতাল-অবরোধে নাশকতায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। এখন আবার সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধুয়া তুলে সহিংস রাজনীতির জানান দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতায় ২৫ দিনে পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে ১৩৩ জন মানুষ দগ্ধ হয়েছেন, নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এছাড়া বিভিন্ন সহিংসতায় ৩৮২টি বাস-ট্রাকে আগুন, রেলে নাশকতামূলক ১৪টি ঘটনায় দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত এবং তিনটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহত এবং পুলিশের ওপর ৮৫টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের পরিসংখ্যানে উল্লেখ আছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের টানা ৯৩ দিনের অবরোধে সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালানো হয়। সারাদেশে পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন ও পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। তখন সারাদেশে নারী ও শিশুসহ অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ৬৪ জন। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ৪১৩ জন। আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোলবোমার দগ্ধ মুখ নিয়ে বন্দী জীবনযাপন করছেন তারা। মুখের আকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় নিজের সন্তানও কাছে আসে না। এমন অসহনীয় জীবন তারা চান না। ক্ষমতার জন্য যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে তাদের ধিক্কার জানিয়ে এমন রাজনীতি পরিহার করারও অনুরোধ করেছে তাদের অনেকে। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের সময় নাশকতায় দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলার তদন্ত চলেছে ধীরগতিতে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে ১ হাজার ৭৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতাসহ মাঠ পর্যায়ের কয়েক হাজার কর্মী। এর মধ্যে যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার অন্তত চারটি ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা আইকন পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে আট যাত্রী নিহত হন। চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশের এক এসআই বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দুইটি দায়ের করেন। মামলায় ৫৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ২০ জনের কথা বলা হয়। একটি মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে আসামি করা হয় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এসব মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকে এখন জামিনে রয়েছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকায় নাপু পরিবহন নামে একটি বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় আট যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলা হয় স্থানীয় থানায়। মামলার প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায় দায়ের করা ৪৫৭টি নাশকতা মামলার মধ্যে তিন শতাধিক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গ্লোরি পরিবহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এ সময় বাসের ভেতর ২৯ জন যাত্রী দগ্ধ হন, মারা যান একজন। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় এক এসআই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। এই মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও ৩৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চার বছর আগের দায়ের করা মামলাগুলোর ঘটনায় যারা হোতা তাদের এখনও বিচার হয়নি। এমনকি মূল হোতাদের অনেকেই এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। নাশকতা ও পেট্রোলবোমার মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার এবং তদন্তে অবহেলার কারণেই তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দাখিল হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তখনকার ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। দেরিতে হলেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পেট্রোলবোমার মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পেট্রোলবোমার সঙ্গে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্নসহ আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশে হরতাল ডেকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোসহ নাশকতা চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো তদন্ত শেষ না হওয়া এবং আসামিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ছাড়াও শুধুমাত্র পেট্রোলবোমা হামলা সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রায় ৫শ‘টির মতো। এর মধ্যে চার্জশীট দেয়া হয়েছে মাত্র অর্ধশতটি। দেশব্যাপী ওই সময়ে সব ধরনের নাশকতার ঘটনায় ১ হাজার ৭১৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে মাত্র ৫২টি মামলার তদন্ত শেষে চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের দায়েরকৃত মামলায় প্রায় ১৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে দুই সহস্রাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে এজাহারে। এই সময়ের মধ্যে রেলপথে ৩৫ ও নৌপথে ছয়টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আর সারাদেশে দুই হাজার ২৮৬টি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়াও ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা আইকন পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে আট যাত্রী মারা যান। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয় চৌদ্দগ্রাম থানায়। একটি মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে আসামি করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এখনও মামলাটির তদন্ত শেষে বিচার কার্য সম্পন্ন হয়নি। দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি করা পেট্রোলবোমা হামলার মামলাগুলোর মধ্যে এটাও অন্যতম মামলা। পুলিশের সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত গত তিন মাসের নাশকতায় বোমা হামলায় মারা গেছেন ৫২ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ২৮১ জন। ককটেল ও অন্যান্য কারণে আহত হয়েছেন ৫৪৯ জন। অন্যভাবে নিহত ২১ জন। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিন মাসে ১৩৮ জন মারা গেছেন, যাদের ৭৭ জনই পেট্রোলবোমার আগুনে নিহত। আহত হয়েছেন অন্তত ৮৩০ জন। পেট্রোলবোমায় যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক ও বাসের যাত্রী। সর্বশেষ গত ২১ মার্চ মাগুরার মঘিররঢাল এলাকায় বালুবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে সাতজন মারা যান। এই ঘটনায় জামাতের এক নেতা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দুই বছর আগের হরতালের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় যারা আসামি আছে তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। হরতালের নামে রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন, আসামিদের গ্রেফতার ও বিচার না হওয়ার কারণে আবারও এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।
×