ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা নীতি ঘোষিত হলো

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা নীতি ঘোষিত হলো

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ বজায় রাখতে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার দুপুরে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে গবর্নর ফজলে কবির ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। ‘সরকারী অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার কমে যাওয়ায়’ বেসরকারী খাতের জন্য ঋণপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন গবর্নর। এদিকে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ফজলে কবির। তবে এ অনুপাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আগামী জুন মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হবে। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে তিনি বলেন, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারি থেকে জুন সময়ের মধ্যে এ খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে সরকারী খাতে ঋণের প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরু থেকেই বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্র্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৯ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারী ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্র আগের মতোই ১৫ দশমিক ৮ শতাংশে স্থির রাখা হয়েছে। নির্বাচনী বছরকে সামনে রেখে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সরকারী খাতে ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে পারে অর্থনীতিবিদদের এমন মতামতকে ‘সমর্থন’ করেই ঋণ প্রবাহের সীমাটা না কমিয়ে উল্টো বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গবর্নর বলেন, অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতির কারণেই বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল বিরাজমান প্রবৃদ্ধি স্থবিরতা কাটিয়ে ব্যাপক-বিস্তৃত গতিশীলতা ফিরেছে। সেই সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও উৎপাদন কর্মকা-ের মূলধনী যন্ত্রাদি ও উৎপাদন উকরণাদি আমদানির জোরালো প্রবৃদ্ধি এসেছে। এ সময়ে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক দুই শতাংশ ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকা-ে আসা অনেকটা আকস্মিক এ জোরালো গতিবেগ দেশজ প্রবৃদ্ধির জন্য বেশ ইতিবাচক। তবে প্রবৃদ্ধির এই জোরালো গতিবেগ বজায় রাখার স্বার্থেই মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতার ওপর চাপের বাড়তি ঝুঁকি কমিয়ে সহনীয় মাত্রায় আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকা-ে প্রবৃদ্ধি গতিশীলতা বজায় রাখতে দ্বিতীয়ার্ধে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবাহে সংকোচন আনা হচ্ছে না। গবর্নর বলেন, জুন মাস পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবাহে বেসরকারী খাতের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে এবার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, আগের মুদ্রানীতিতে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক দুই শতাংশ। আর আগামী জুন পর্যন্ত এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক তিন শতাংশ। এদিকে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। তবে এই অনুপাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আগামী জুন মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হবে। তবে কোন ধরনের ব্যাংকে এডিআর হার কত হবে তা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে বলে জানান গবর্নর। গবর্নর ফজলে কবির বলেন, আমরা ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডি রেশিও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের জন্য একটি গাইড লাইন মেনে করি। এবারও সেই গাইড লাইন মেনে এ রেশিও নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা, এনপিএলসহ (নন পারফরমিং লোন) বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তা নির্ধারণ করা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২০টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক তাদের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর এর সীমা অতিক্রম করেছে। আমরা তাদের সীমার মধ্যে আসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে আগামী ৬ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক অবস্থানে আসতে পারে। তার মতে, ব্যাংকগুলো আমানত বাড়ানোর মাধ্যমে এটি করবে বলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এসময় ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর অনেক কম। কারণ তারা কোয়ালিটি ঋণের দিকে যাচ্ছে। তবে এসব ব্যাংক এডিআর হার বাড়াবে বলে মনে করেন তিনি। মূলত ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানত নিয়েই ঋণ বিতরণ করে। এতে সাধারণ ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে; তার সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামী ধারার ব্যাংক আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। তবে সম্প্রতি বেশিরভাগ বেসরকারী ব্যাংকেরই এডিআর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এতে ওই সব ব্যাংক ১০০ টাকার মধ্যে ৯০ টাকাই ঋণ বিরতণ করছে। এতেই সৃষ্টি হয়েছে তারল্য বা নগদ টাকার সঙ্কট। চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরতের বিষয়ে জানতে ফজলে কবির বলেন, মোট চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফেরত এসেছে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এর বাইরে ৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত আসার বিষয়ে আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তিনি বলেন, এক দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার (১২ লাখ ডলার) বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আসার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া আরও ছয় মিলিয়ন ডলার আসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ ছয় মিলিয়ন ডলার আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির একটি দল আজ রাতে (সোমবার) ফিলিপাইনে যাচ্ছে। নতুন ব্যাংকের অনুমোদনে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন গবর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, নতুন ব্যাংক আসা বন্ধ করার কারণ নেই। তবে আমি এটা বলছি না যে, নতুন ব্যাংক আমরা হঠাৎ করে ইউটার্ন করে নিচ্ছি। তা মোটেও নয়। আমরা সেটা অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। গবর্নর বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি আমরা দেখি বা বোর্ড যদি মনে করে সেটা হবে না, তবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা কোনোভাবে রোধ করা যায় না। ফজলে কবির বলেন, চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকের অবস্থা খুব ভাল যাচ্ছে না। দুই একটা ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। অনেক সময় মার্জারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই। গত বছরের শেষ দিকে ব্যাংক খাতে চরম অস্থিরতা দেখা যায়। শুরুটা ইসলামী ব্যাংক দিয়েই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সভায় পরিবর্তন আনা হয়। তারপর আর থামেনি। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে অস্থিরতা লেগেই ছিল। বিশেষ আলোচনা ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায় আসা ৯ ব্যাংক। আলোচনায় বাদ যায়নি ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ আর বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে এক করে দেয়ার পরামর্শ দেন। গবর্নর ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকগুলোর মার্জারের বিষয়টি তাদের অপশন। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইন অর্থাৎ দেশের বিদ্যমান আইনে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু করার নেই। বা সরকার থেকে করার কিছু নেই। তিনি বলেন, কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংক মার্জ হবে সে সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। তারা চাইবে মার্জিং এর জন্য। এখনো এটার ক্ষেত্রে অন্য কোনো আইন নেই। কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। মূলধনের অপর্যাপ্ততা হয়েছে। কিছু বোর্ড বা মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এ ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে গবর্নর বলেন, মালিকানা পরিবর্তন তো হতেই পারে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিজনেসের স্বাভাবিক নিয়ম। একজন মালিক তার শেয়ার অন্যজনের কাছে বিক্রি করতেই পারে।
×