ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ নেতাদের আভাস

ক্ষমতার পাল্লা যেদিকে ভারি সেদিকেই থাকবে এরশাদের জাপা!

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

ক্ষমতার পাল্লা যেদিকে ভারি সেদিকেই থাকবে এরশাদের জাপা!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আলোচনা অনেক। ফের আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন। নয়ত একক বা জোটগত নির্বাচন। আবার তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি উত্থানের চেষ্টাও অব্যাহত। তবে সঠিক পথ কখন ঠিক হবে কেউ জানে না। পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের ওপর। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমন প্রস্তুতি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। তবে দলটির শীর্র্ষ নেতারা বলছেন, নানামুখী প্রস্তুতি থাকলেও রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার প্রয়োজনে যে কোন সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে জাপা। এরশাদের বিগত দিনের রাজনীতি তাই প্রমাণ করে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েও শেষ মুহূর্তে তিনি সরে দাঁড়ান। যদিও নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে কোন জোটে যাবেন এ নিয়ে ছিল চরম নাটকীয়তা। এর আগেও বিএনপি-আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানামুখী নাটকীয়তা লক্ষ করা গেছে সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদের। সব মিলিয়ে যেদিকে ক্ষমতা থাকার পাল্লা ভারি থাকবে সেদিকেই থাকবে এরশাদের দল। এমন বক্তব্য খোদ দলটির শীর্ষ নেতাদের। এদিকে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। প্রার্থী বাছাই ও চূড়ান্ত করার পর চলছে ইশতেহারের কাজও। দলটির লক্ষ আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও বিরোধী দলের অবস্থান কোন মতেই হারাতে চান না এরশাদ। তাই নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছে জাপা। এদিকে দলীয় দায়িত্বশীল নেতাদের তালিকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীকে ডেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলছেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে। তবে আগামী নির্বাচনে জাপা থেকে বেশকিছু নতুন মুখ আসারও সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রাথমিক ইশতেহার ঘোষণা করা হতে পারে। তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য পাচ্ছে এবারের ইশতেহারে। দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী বাছাই শেষ। কাউকে-কাউকে বলছি, পরামর্শ দিচ্ছি। তাছাড়া শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, জেলা নেতাদের তালিকা ধরেই ৩০০ আসনে দলের প্রার্থী তালিকা প্রায় চূড়ান্ত। জাপার একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সম্প্রতি জেলা নেতাদের যোগ্য প্রার্থীদের নাম দিতে চিঠি পাঠানো হয়। নির্দেশ অনুযায়ী জেলা-উপজেলা নেতারা বৈঠক করে কেন্দ্রে চিঠি পাঠায়। সব আসনে তিনজন প্রার্থীর নামও রয়েছে। জেলা থেকে পাঠানো তালিকা ধরে এরশাদ নিজে থেকেই প্রার্থীদের ডেকে কথা বলছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। বলছেন, জাতীয় পার্টির আমলের ভাল দিকগুলো গ্রামে গিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতে। সে অনুযায়ী কিছুটা কাজও শুরু হয়েছে। মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপও শুরু করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে। যদিও সম্মিলিত জাতীয় জোট থাকায় শরিকদের বিষয়টিও মাথায় রাখছেন এরশাদ। এ কারণে সকল মনোনয়ন চূড়ান্ত ও নাম ঘোষণা করা থেকে বিরত রয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালের এক অক্টোবর সিলেটে শাহজালাল (রহ) মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন জাপা চেয়ারম্যান। এ সময় তার সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের নির্বাচিত সাংসদসহ সম্ভাব্য প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর তিনি সিলেটে এক জনসভায় ওই এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা না করলেও তাদের মঞ্চে রেখেছিলেন। এরপর তিনি রংপুর, রাজশাহী, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় সফর করেন। কথা বলেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সঙ্কট থাকলেও দলের পক্ষ থেকে ৩০০ আসনে প্রার্থী নিশ্চিত করতে চান এরশাদ। জাপার কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, চেয়ারম্যান আমাদের থেকে নাম নিয়েছেন। আমরা যারা জেলার দায়িত্বে ছিলাম, তালিকা করে তাকে দিয়েছি। এখন মনোনয়নের বিষয়টি তিনিই দেখবেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডেকে নির্বাচনের আউটলাইন বাতলে দিচ্ছেন এরশাদ। এ প্রসঙ্গে জাপা প্রধান এরশাদ বললেন, ‘জাপা নির্বাচন করবে জোটগতভাবে। এ কারণে জোটের সঙ্গে বৈঠক করেই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে।’ দলের অন্তত পাঁচ জন প্রেসিডিয়ামের সদস্য ও একাধিক যুগ্ম-মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোন জোটে গিয়ে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে যোগ্য প্রার্থী ঠিক করে তালিকা চূড়ান্ত হবে নির্বাচনের অনেকটা আগে ভাগেই। তালিকা নিয়ে বড় কোন দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া বা আসনের দরকষাকষি হবে। যদিও এরশাদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারবারই বলে আসছেন একক ও তার দলের নেতৃত্বে গঠিত জোট নিয়ে নির্বাচন করার। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই- একথাও বলেন বারবার মত পাল্টানো নেতা এরশাদ নিজেই। শেষ পর্যন্ত তিনি কি সিদ্ধান্ত নেবেন তা সময়ই বলবে। তৈরি হচ্ছে ইশতেহার ॥ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরশাদের নির্দেশে দলের ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে। এজন্য একটি পৃথক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এতে দলের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীও রয়েছেন এই কমিটিতে। ইশতেহার কমিটির সঙ্গে যুক্ত এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিপাদ্য থাকবে তিনটি বিষয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থার পদ্ধতির সংস্কার ও পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন। আমরা ক্ষমতায় গেলে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করব। এছাড়া জনকল্যাণমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয়গুলো ইশতেহারে প্রাধান্য পাবে। জাপা সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে আগে ইশতেহার ঘোষণা করার রেওয়াজ থাকলেও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে। ইশতেহারও ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টিও নিজেদের শক্তির জানান দিতে নির্বাচনের আগে ভাগেই ইশতেহার ঘোষণা করতে চায়। জাপা মহাসচিব এবি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও প্রেসিডিয়ামের সদস্য, এরশাদের রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভরায় ইশতেহার তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ইশতেহারে কি থাকছে এ ব্যাপারে তারা সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ। জাপা সূত্র জানায়, নির্বাচনের জন্য ৩শ আসনেই প্রার্থী প্রস্তুতি রাখছে জাপা। এক্ষেত্রে জোটের শরিক দলগুলোকে মাথাপিছু দুই থেকে তিনটি আসনে সমর্থন দেয়ার চিন্তা আছে দলটির। এরশাদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের বেশিরভাগ দলই অনিবন্ধিত। জাপা ও ইসলামী ফ্রন্ট ছাড়া বাকিদের সংগঠনের পাশাপাশি কোন জনভিত্তি নেই। এমনকি রাজনৈতিক কার্যালয়ও নেই বেশিরভাগ দলের। তাই বর্তমানে রাজনীতির মাঠে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করলেও শরিক দলগুলোর জনসমর্থন না থাকায় এর ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে জাতীয় পার্টি এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ইতোমধ্যে শতভাগ প্রার্থী পাওয়া গেছে। সহসাই দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির নয় বছরের শাসনামল মানুষের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য। তাই ইশতেহারে দলের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে দেশবাসী বিশ্বাস করে ক্ষমতায় গেলে জাপা সবকিছুই বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেছেন, এবারের জাপার ইশতেহারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। এছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ ক্ষমতায় গেলে মানুষের কল্যাণে যা যা করা প্রয়োজন সে বিষয় মাথায় রেখেই ইশতেহার প্রণয়নের কাজ চলছে। বাবলা আরও বলেন, পল্লীবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠন করেছে। এই জোটের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। নির্বাচনের আগে সময়ের দাবিতে আমরা বড় কোন দলের সঙ্গে ঐক্য করেও নির্বাচনে যেতে পারি। তবে যে দলের সঙ্গেই জোট করি না কেন, সেই দলকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী।
×