ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশাহারা মা-ভাই

ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা হারানো জবি ছাত্রীর পরিবারে মাতম

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা হারানো জবি ছাত্রীর পরিবারে মাতম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা হারালেও স্বপ্ন হারিয়ে যায়নি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী রুবিনা আক্তারের। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা তা জানে না এই মেধাবী ছাত্রী। পিতার মৃত্যুর পর তার রোজগারেই সংসার চলছিল। রুবিনার এমন পরিস্থিতিতে পরিবারটির পথে বসার যোগাড় হয়েছে। অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দিশাহারা রুবিনার মা আর তার একমাত্র ভাই। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। রুবিনার চিকিৎসার ব্যয় বহন করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আরও উন্নত চিকিৎসা দিতেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত আছে। তবে রুবিনা পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন। তাকে আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) রাখা হয়েছে। রবিবার দুপুরে গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানাধীন শান্তিনগরে যাওয়ার উদ্দেশে কমলাপুরে রেলস্টেশনে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অর্নাস শেষ বর্ষের ছাত্রী রুবিনা। দুপুর দেড়টার দিকে রেলস্টেশনের ৬ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে হেঁটে ৫ নম্বর প্লাটফর্মে যাচ্ছিলেন। এ সময় ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরানোর কাজ চলছিল। সেই ইঞ্জিনে কাটা পড়ে উরু থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত রেলপুলিশ ও রেল কর্তৃপক্ষ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রুবিনাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তিনি শঙ্কামুক্ত নন। ঘটনার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল বলে রুবিনা জানায়। চিকিৎসক রুহুল আমীন জানান, ট্রেনে কেটে পড়ার পর যেসব অংশ থেতলে গিয়েছিল দুই পায়ের সেসব অংশ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। রুবিনার সহপাঠী ইমাম হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, রুবিনা খুবই ধর্মভীরু মেয়ে। সাধারণত কারও সঙ্গে বেশি মেলামেশা করত না। নিজের ব্যক্তিগত বিষয় সর্ম্পকেও তেমন কারও সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করত না। হাতে গোনা দু’একজন বান্ধবীর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। ওই বান্ধবীদের মাধ্যমে জানা গেছে, রুবিনা ঢাকায় ৪টি টিউশনি করত। তার টিউশনির টাকায় গ্রামে থাকা মা ও রংপুর কারমাইকেল কলেজে একমাত্র ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা চলত। থাকত বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সদরঘাট এলাকার একটি ছাত্রীনিবাসে। ইমাম হোসেন বলছিলেন, রুবিনা বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখত। তার সেই স্বপ্ন এখনও জিইয়ে রেখেছে। তার সংসারের অভাব ঘুচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করত। ভবিষ্যতে সে তার মা ও ভাইকে ঢাকায় তার কাছে রাখার ইচ্ছে পোষণ করত। এজন্য সে খুবই ভাল চাকরি করার স্বপ্ন দেখত। আর চাকরির দিক থেকে প্রথম পছন্দ ছিল বিসিএস কর্মকর্তা হওয়া। তিনি আরও জানান, ঘটনার দিন রবিবার অন্যান্য দিনের মত রুবিনা তাদের সঙ্গে ক্লাস শেষ করে। ক্লাস শেষে ইন্টার্নি ক্লাস করার কথা ছিল তার। ইন্টার্নি না করে সে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে বাসযোগে বাড়িতে যাতায়াত করত। কিন্তু ওইদিন সে ট্রেনে যাওয়ার জন্য কমলাপুরে যায়। আর সেখানেই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনাটি। রুবিনার এই সহপাঠী আরও জানান, ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রুবিনার চিকিৎসার জন্য সব ধরনের আর্থিক সহায়তা করছে। সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. সেলিম ভূঁইয়া হাসপাতালে এসে রুবিনার খোঁজখবর নেন। তারা রুবিনাকে সব ধরনের চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানান। রুবিনা সংবাদ মাধ্যমকে তার ছবি না ছাপানোর অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, রুবিনার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আরও উন্নত চিকিৎসা দিতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে। অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, রুবিনা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন। রুবিনার বিষয়টি মানবিক কারণেই খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। হাসপাতালে রুবিনাকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চাচা রফিকুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মূলত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমি সাভারে ছোট একটি চাকরি করি। আমরা চার ভাই চার বোন। রুবিনার বাবা রবিউল ইসলাম। ২০১৪ সালে তিনি মারা যান। আর রুবিনার মা রহিমা বেগম। সবাই পৃথক। বাড়ি ভিটাসহ রুবিনাদের দেড় বিঘার মতো জমি আছে। এই জমি চাষ করেই রুবিনাদের কোন মতে সংসার চলত। ওরা দুই বোন এক ভাই। রুবিনার বড় বোন জুলেখা। ও মানসিক রোগী। রুবিনা এসএসসি ও এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট করেছে। স্কুলের দরিদ্র তহবিলসহ স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এসএসসি পাস করে। রেজাল্ট ভাল হওয়ায় স্কুলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে এইচএসসি পাস করে। এখানেও ভাল রেজাল্ট করে। এরপর ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। রুবিনার বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার আর চলছিল না। রুবিনা ঢাকায় টিউশনি করত। সেই টিউশনির টাকায় গ্রামে থাকা এক বোন আর মায়ের সংসার চলে। আর রুবিনার ছোট ভাই রুবেল রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়ে। তারও পড়াশোনার খরচ চালাত রুবিনা। রুবিনার এমন অবস্থায় আমরা একেবারে দিশাহারা। আমাদেরও তাদের সহায়তা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। ওর মা আর ভাই একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেছে। পরিবারটির কি হবে আল্লাহ্ জানেন।
×