ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী

চীনের পর ব্যবসায়ীদের গন্তব্য কোথায় হবে? গত দুই দশক ধরে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ চীন ছিল ক্রমাগত বেড়ে উঠতে চাওয়া প্রায় প্রতিটি বৈশ্বিক কোম্পানির বাজার। কিন্তু চীনের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ায় ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফার চাকা সচল রাখার জন্য পরবর্তী ভোক্তাবাজারের সন্ধান করছে। অনেকের কাছে মনে হচ্ছে ভারতই হবে তাদের পরবর্তী সেই বাজার। এর জনসংখ্যা শীঘ্রই চীনের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। মাঝে মাঝে দেশটির প্রবৃদ্ধির গতি এমন হয় যে, সেই গতিতে চলে চীন অর্থনৈতিক পরাশক্তির মর্যাদা লাভ করেছিল। অনেকের মতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমৃদ্ধির পথে আদি পর্বে সেই যাত্রার মধ্য দিয়ে চীনে কোটি কোটি ভোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। উচ্ছ্বসিত ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টারা বলেন যে, ভারতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি সম্ভাবনাময় ভোক্তা আছে যারা ফ্রাদুচিনো খাবে, ফিয়েস্তা গাড়ি চালাবে, বিশ্বময় ঘুরে বেড়াবে। ভারত সফরে এসে কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এই দেশটিকে তার পরিকল্পনার প্রধান বাজার বলে ঘোষণা করেন না এমনটা কদাচিৎই দেখা যায়। কারও কারও এ জাতীয় উক্তিকে তোষামোদের কূটনৈতিক ডোজ বলে মনে হতে পারে। তবে আইকিয়া, সফটব্যাংক, এ্যামাজন, স্টাররাকস্রে মতো ফার্ম থেকে শুরু করে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবেই এমন মন্তব্য করে থাকে। তবে বাজার বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শকরা ভারতের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা বলছেন বাস্তবে তার অস্তিত্ব আছে ছিটেফোঁটা। সাবান, ম্যাচ ও ফোন-ক্রেডিটের বাইরে অন্যান্য পণ্যের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশকে টার্গেট করে। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের শীর্ষ ১ শতাংশ হচ্ছে ৮০ লাখ অধিবাসীর এক সমৃদ্ধ মহল, যাদের মাথাপিছু আয় বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার। জনসংখ্যা ও গড় আয়ের হিসাবে এটা মোটামুটি হংকংয়ের সমান। পরবর্তী ৯ শতাংশের আয় মধ্য ইউরোপের মতো যেটির অবস্থান বৈশ্বিক সম্পদের মাঝামাঝি। এর পরের ৪০ শতাংশের আয় দক্ষিণ এশিয়ার দুই দরিদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমষ্টিগত আয়ের সমান। অবশিষ্ট ৫০ কোটির মতো মানুষের অবস্থা আফ্রিকার অধিকাংশ হতদরিদ্র মানুষের আয়ের সঙ্গে তুলনীয়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো মধ্য ইউরোপের বাজারগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। সেখানে প্রচুর সম্পদ করায়ত্ত করা যায়। কিন্তু সেই দেশগুলো চীনের মতো নয়। তার চেয়েও খারাপ কথা হলো, মধ্য ইউরোপের সমকক্ষ হওয়ার মতো ভারতে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্ভাবনা অসাম্যের কারণে রুদ্ধ হচ্ছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যে বাড়তি আয় সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই করায়ত্ত করেছে আয়ের দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী প্রায় ১ শতাংশ মানুষ। বিত্তশালীরা এখন ১৯৮০ সালের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ধনী। মধ্য আয়ের লোকদের আয় এ সময় দ্বিগুণও হয়নি। ক্রয় ক্ষমতার অনুপাতে যাদের আয় ২ ডলারের নিচে ছিল তাদের আয় বাড়িয়ে ৩ ডলারে উন্নীত করতে ভারত সাফল্যের পরিচয় দিলেও অন্যান্য দেশ সেখানে রোজগারীদের আয় ৩ ডলার থেকে ৫ ডলারে এবং ৫ ডলারের রোজগারীদের আয় ১০ ডলারে উন্নীত করতে পেরেছে, কিন্তু ভারত তাদের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের মতো উন্নয়নের স্তরে থাকা দেশগুলোর মধ্য আয়ের লোকেরা সাধারণত প্রবৃদ্ধি থেকে অধিকতর সুফল গ্রহণ করে থাকে। ১০ জন ভারতীয়ের মধ্যে ৮ জন অসাম্যকে দুর্নীতির সমপর্যায়ের এক বিরাট সমস্যা বলে মনে করে। এই ব্যর্থতার কারণগুলো রহস্যময় কিছু নয়। কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থাকার কারণে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগে খানিকটা উদার অর্থনীতি যখন চালু করা হয়েছিল তখন তা থেকে অতি সামান্য কিছু মানুষই লাভবান হতে পেরেছিল। শ্রমশক্তি নিদারুণ অনুৎপাদনশীল। এতে অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই। কেননা, ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। এই ব্যবস্থা থেকে লাখ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক শুধু মানসিক কাজ করতে পারার যোগ্যতা নিয়েই বেরিয়ে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ স্নাতকরা বেসরকারী পর্যায়ে পরিচালিত ছোট-বড় শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যায়। এভাবেই সব ভারতীয় মধ্যে ৯৩ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়। চীন যখন নিজেকে বিশ্বের কারখানায় পরিণত করেছিল তখন সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চাকরি-বাকরি সুযোগের ব্যাপক স্ফীতি ঘটেছিল। কিন্তু ভারতে এমন অবস্থা দেখতে পাওয়া যাবে না। কারণ ছোটখাটো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনশীল বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজটা আমলাতন্ত্র প্রায় অসম্ভব করে তোলে। নারীদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ কাজ করে। শ্রমে তাদের অংশগ্রহণ এক দশকে দারুণ হ্রাস পেয়েছে। এতেও শ্রম পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতি হয়নি। সঠিক ও উত্তম নীতি নেয়া হলে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটতে পারে। তবে এ ব্যাপারে শুধু আশাবাদী হলেই চলবে না, বাস্তবতাবোধ দ্বারাও চালিত হতে হবে। ভারতের রয়েছে গভীরে প্রসারিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে সেই ব্যবস্থা দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন রক্ষাকবচ নয়। যেমন, ২০১৬ সালে হঠাৎ করে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোট বাতিলের কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও বলা হয়েছিল কালো টাকার মালিকদের ধরাই এর লক্ষ্য। কিন্তু কালো টাকার মালিকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষ। চীন যে পথ ধরে অগ্রসর হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল সেটা ছিল কারখানা শিল্পের ব্যাপক প্রসার। এতে করে ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছিল এবং আয়ও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হালে অটোমেশনের ব্যাপক প্রসারের ফলে কল-কারখানায় কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে বিধায় ভারতের বেলায় ওই পথটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা ভারতকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিল তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে মনে হয়েছিল ভারত একটা সোনার পাখি যা প্রতিদিন তাদের সোনার ডিম উপহার দেবে। সেই সোনার পাখি আর কেউ নয়Ñ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাদের হিসেবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ কোটি। এইচএসবিসি ব্যাংক সম্প্রতি ৩০ কোটি ভারতীয়কে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওতাভুক্ত করেছে। ব্যাংকটির হিসাবে এই সংখ্যা ২০২৫ সাল নাগাদ ৫৫ কোটিতে পৌঁছবে। কিন্তু বেশকিছু ফার্ম এই কঠিন সত্যটিও অনুধাবন করেছে যে, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকের হাতে ব্যয় করার মতো অর্থ তেমন নেই। ভারতে ধনী লোক অনেক আছে। তবে তাদের সংখ্যা কয়েক লাখের বেশি নয়। তাদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি সংখ্যক লোক দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। তবে এত ওপরে ওঠেনি যে পরিবারের অন্ন সংস্থানের চেয়ে অন্য কিছুর পেছনে ব্যয় করার মতো বেশি অর্থ তাদের হাতে আছে। তাই যেসব কোম্পানি ভারতকে কাজে লাগানোর সুযোগ হিসেবে দেখেছিল তারা এখন লক্ষ্য করছে যে, খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। তাদের প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি অনেক কম। ই-কমার্সের কথাই ধরা যাক। কোটি কোটি ভারতীয় অনলাইনে কেনাকাটা করবে এই প্রত্যাশা থেকে এ্যামাজন ও তার স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভারতীয় বাজারে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগে প্রণোদিত হয়েছিল। শিল্পের রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১০০ শতাংশের ওপরে থাকায় বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ২০২০ সাল নাগাদ অনলাইনে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি ডলার যা আজকের মোট বিক্রির তুলনায় ৫ গুণ। কিন্তু সেটা এখন অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৬ সালে ই-কমার্সে বিক্রি আদৌ তেমন একটা বাড়েনি। ২০১৭ সালে কিছুটা ভাল হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কোনভাবে ছাড়িয়েছে। বছরের পর বছর গ্রাহকদের নানা ধরনের ডিসকাউন্ট দিয়ে প্রলুব্ধ করার পরও ভারতে অনলাইনে সক্রিয়ভাবে কেনাকাটা করছে এমন লোকের সংখ্যা সম্ভবত ৫ কোটি। মোটামুটিভাবে তারা হচ্ছে জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ। ডলারের হিসেবে ২০১৭ সালে ভারতে ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধি ছিল চীনের এক সপ্তাহের মতো প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনীয়। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তেমন বিকশিত না থাকায় শিল্পের মধ্যে বড় টেক কোম্পানিগুলো সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। এক বছরে এ্যাপল তার বৈশ্বিক আয়ের ০.৭ শতাংশ অর্জন করেছে ভারতে। ভারতে ফেসবুকের ২৪ কোটি ১০ লাখ গ্রাহক। কোন একটি দেশে সম্ভবত এটাই সর্বাধিক গ্রাহক। তবে এক বছরে ফেসবুকের আয় হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে গুগলের প্রসার অধিকতর ধীরগতিতে হয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডস, ডোমিবো পিৎজা ও কেএফসির মতো ফুড চেইন শপগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারছে না। স্টারবাকস বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল। তবে গত দু’বছরে মাসে প্রায় একটি করে নতুন কফি শপ খুলেছে। অথচ চীনে প্রতি ১৫ ঘণ্টায় স্টারবাকের নতুন দোকান খুলে। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সংখ্যায় ছোট ও অবিকশিত। অবশ্য এই শ্রেণীটি বিত্তবান না হলেও যারা ধনী তারা সত্যিই ধনী। ভারতে মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ২ লাখ। বিলিয়নিয়ার রয়েছে ১০১ জন এবং প্রতি দু’মাসে ১ জন যোগ হচ্ছে। চূড়ান্ত হিসেবে ভারতে সম্পদের পরিমাণ মোটামুটিভাবে সুইজারল্যান্ডের (জনসংখ্যা ৮০ লাখ) কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার (জনসংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ) সঙ্গে তুলনীয়। ভারতের জনসংখ্যা চীনের সমান হলে ও ভারতের শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের সংখ্যা যত মোটামুটি সেই সংখ্যক জনগোষ্ঠী এবং তারা ক্রয় ক্ষমতাসম্পন্ন হলে এমন হবে যে মধ্য ইউরোপের সঙ্গেই ভারতের তুলনা করা চলে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা স্বীকার করেন যে, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী আকারে ছোট। তবে তারা আশাবাদী এই শ্রেণীটির ব্যাপক বিকাশ বা সংখ্যাস্ফীতি শীঘ্রই ঘটবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×