ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর জ্যাক উরওয়িতয

জর্জ হ্যারিসন থেকে মোজাম্মেল খান

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

জর্জ হ্যারিসন থেকে মোজাম্মেল খান

প্রায় চল্লিশ হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত কানাডার অন্টারিও প্রদেশের টরন্টো শহরের উপকণ্ঠে শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি যখন তার ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে, তখন প্রথমবারের মতো একজন অধ্যাপককে সম্মান জানিয়ে একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটির নাম ‘ঞৎধহংভড়ৎসরহম খরাবং ধঃ ঝযবৎরফধহ : অ ঞৎরনঁঃব ঃড় উৎ. গড়ুধসসবষ কযধহ.’ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোজাম্মেল খান ২৩ বছর আগে এসেছিলেন শেরিডানে। এই বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত সমস্ত আয় ‘মোজাম্মেল খান বৃত্তি ফাউন্ডেশন’ নামে শেরিডান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ফান্ডে জমা হবে এবং সেটা থেকে প্রতি বছর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছঁধষরঃু ঊহমরহববৎরহম বিভাগের একজন ছাত্রকে স্কলারশিপ দেয়া হবে। এ ছাড়া গত ৩০ আগস্ট শেরিডানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মোজাম্মেল খানকে ‘বাবৎুফধু যবৎড়’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটা এক বিরল সম্মান। পরিশেষে তাঁকে এ দেশে নতুন আসা মানুষদের জীবন পরিবর্তনে অবদান রাখার জন্য এ প্রদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘ঙৎফবৎ ড়ভ ঙহঃধৎরড়’র জন্য মনোনীত করা হয়েছে। তিনি কানাডায় আসার পর ছঁধষরঃু ঊহমরহববৎরহম (পোস্ট গ্রাজুয়েট) নামে যে বিভাগটি প্রায় ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠাত করেন, সেটা এ প্রদেশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একমাত্র বিভাগ সে সে বিভাগ থেকে পাস করা ৬০ জনেরও বেশি গ্রাজুয়েট কানাডার জীবনে কিভাবে এ বিভাগের শিক্ষা পরিবর্তন এনেছে, সে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বইটির ভূমিকা লিখেছেন শেরিডানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন এবং শেরিডানের অনুষদ ইউনিয়নের সভাপতি অধ্যাপক জ্যাক উরওয়িতয এবং কানাডার পেশাগত প্রতিষ্ঠানের কয়েক নেতা। মোজাম্মেল খান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক, অধ্যাপক, কলামিস্ট, একাডেমিক মুক্তিযোদ্ধা, সিনেটের স্পীকার। একই ব্যক্তির মাঝে সবকিছুর প্রকাশ এবং মানবতার চরম স্বাধীনতা ও বিশ্বাসের প্রতি প্রেম তাঁর ভেতর স্থান করে নিয়েছে। মোজাম্মেলের মন থেকে তাঁর জন্মভূমির রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার কথা কখনও হারিয়ে যায়নি। অনুষদ ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আমি অধ্যাপক খানকে জানতে পেরেছি। আমি আরও জেনেছি একজন কলামিস্ট/লেখক এবং একজন বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতা হিসেবে। মোজাম্মেল শ্রেণীকক্ষের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক জীবন কখনই নিয়ে আসেননি। যার ফলে যে দেশটি তাঁর দেশের জনগনের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, সে দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীসহ পৃথিবীর সব দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি সমভাবে শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি প্রকৌশল বিদ্যার একজন অধ্যাপক। তাঁর বইতে এবং প্রবন্ধে তিনি নিজেকে শুধু একজন শেরিডান অধ্যাপক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করেছেন। মোজাম্মেল এবং আমি শেরিডান অনুষদের একাডেমিক ফ্রিডমের জন্য যুদ্ধ করেছি প্রথম থেকে। আমি নিশ্চিত সেই আগের যুদ্ধ সিনেটের স্পীকার হতে তাকে প্রেরণা জুগিয়েছে। কিন্তু আমি খুবই খুশি যে আমাদের সিনেটের স্পিকারের হাতুড়িটি এমন একজন মানুষের হাতে গিয়েছে, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। আমরা সমসাময়িক, কিন্তু আমাদের প্রথম জীবন ভীষণভাবে বিভিন্ন। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শান্তি ও সমৃদ্ধির সময় বেড়ে ওঠা একজন তরুণ হিসেবে আমি যখন পপকর্ন হাতে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিরুদ্ধে চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশে জর্জ হ্যারিসনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ দেখছি, তখন মোজাম্মেল চলছিল একটি দুঃস্বপ্নের মাঝে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। তাঁর দেশে পরিচালিত ধ্বংসযজ্ঞ, লাখ লাখ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার মানসে একটি গণহত্যার বিরুদ্ধে এক মরণপণ যুদ্ধের ময়দানে। আমাদের তরুণ জীবনের সেই বৈপরীত্য সত্ত্বেও এটা এক অলৌকিক ব্যাপার যে, আমরা এখন কানাডা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থানে সহকর্মী। অদ্যাবদি সঠিক সংখ্যা অজানা, কিন্তু সব নির্দলীয় অনুমানে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। আজ বাংলাদেশ সফল জাতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি জাতি, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের সহঅস্তিত্ব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। এটা সম্ভব করেছেন মোজাম্মেল খানদের মতো সচেতন কর্মীরাই। তাঁদের লেখা এবং অন্যান্য কাজের মধ্য দিয়েই বহুমত বিশ্বাসের মানুষের সহাবস্থানের বর্তমান সংস্কৃতি জীবিত রাখার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য মোজাম্মেলের লড়াই এ উদাসীন বিশ্বের শান্তি রক্ষায় এক বিরাট যুদ্ধেরই অংশ। বাংলাদেশে ধর্মীয় সহাবস্থান তাঁর স্বপ্নের একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব, ঠিক যেমন কানাডা পরিপূরক সংস্কৃতির একটি সফল মোজাইক। অধ্যাপক খান উভয়কেই তাঁর মাঝে সফলভাবে ধারন করছেন। লেখক : প্রফেসর জ্যাক উরওয়িতয শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রায় তিন হাজার অধ্যাপক সদস্য সংবলিত অনুষদ ইউনিয়নের সভাপতি। (ইংরেজী থেকে অনুবাদ : তাসরীনা শিখা)
×