ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরার বাড়িতে ভাল নেই মুক্তামণি, মাচায় শুয়েই দিন কাটে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

সাতক্ষীরার বাড়িতে ভাল নেই মুক্তামণি, মাচায় শুয়েই দিন কাটে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ঢাকা থেকে যেমন ফোলা ডান হাত নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, এখন হাত তার চেয়েও বেশি ফুলে উঠেছে। হাত নাড়ানো এখন দায়! একটু আঘাত লাগলে যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠছে সে। এ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা আসতে গেলে ধাক্কায় প্রচ- কষ্ট পাওয়ার ভয়ে আর ঢাকা আসতে চাইছে না সাতক্ষীরার মুক্তামণি। তাছাড়া কোন প্রকার উন্নতি না হওয়ায় হতাশ তার পরিবার। এখন বাড়ির আঙ্গীনায় তৈরি করা মাচায় শুয়ে শুয়েই দিন কাটে মুক্তার। দেহের চেয়ে মোটা হাত নিয়ে নিজে তো আর হাঁটতে পারে না। প্রতিদিন সকালে তার বাবা-মা তাকে ঘর থেকে বের করে মাচায় শুইয়ে দেন। দিনের বেলা সেখানেই তার খাওয়া, ঘুমসহ অবসর সময় কাটাতে হয়। মুক্তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, একটু বেলা হওয়ার পর সকাল ১০টা-১১টার দিকে বের করা হয়। আছরের নামাজের পর আবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো হাতের ব্যান্ডেজ দুই ঘণ্টা খুলে রাখা হয়। এ সময় সেখানে মলম লাগানো হয়। তিনি বলেন, মলম লাগানোর পর ব্যান্ডেজ দেই। ব্যান্ডেজটা আমরাই দিতে পারি। চিকিৎসকরা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সারাদিনই শুয়ে শুয়েই তার দিন কাটে। বেশি সময় বসে থাকতে পারে না। দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার পর কিছু সময়ের জন্য হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয় । কিন্তু সে বেশি সময় বসে থাকতে পারে না। ছয় মাস ১০ দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২২ ডিসেম্বর ফোলা হাত নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় মুক্তামণিকে। এ সময় চিকিৎসকরা তাকে মাসখানেক পরে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল। বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মুক্তার বাবা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বলেন, ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। সমস্যার কথা তাদের জানাচ্ছি। একটু গরম পড়লে তারা নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু মেয়ে তো আর যেতে চাইছে না। তাকে আর বাইরে বের করার মতো নেই। দেহের চেয়ে তার হাত দিন দিন মোটা হচ্ছে, এ্যাম্বুলেন্সে করে যে নিয়ে যাব তেমন কোন অবস্থা নেই। হালকা একটু ধাক্কা লাগলে তার মন হয় যেন জান বের হয়ে যাচ্ছে। একটু নাড়াচাড়া লাগলেই সে প্রচ- ব্যথা পায়। ধাক্কা লাগলে কোন প্রকারে সহ্য করতে পারে না। হতাশা প্রকাশ করে ইব্রাহীম হোসেন আরও বলেন, ছয়টা মাস ওখানে গিয়ে থেকে আসলাম। সামান্যতমও যদি উন্নতি হতো, তাহলে মনে করেন, সেই ভরসায় যাওয়া যেত। আগে ভাবতাম দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু ছয় মাসেও কোন উন্নতি হয়নি। আবার কোন ভরসায় তাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এতো দিন চিকিৎসা করানোর পরও কোন প্রকার পরিবর্তন লক্ষ্য করতেছি না। বরং হাতটা ফুলে আরও মোটা হয়েছে। অপারেশনের পরে একটু ফোলা কমেছিল। কিন্তু আবার সেই আগের মতো হয়ে উঠছে। সঙ্গে ব্যথা ও চুলকানি। এর চেয়ে ডাক্তাররা যদি মেয়ের হাতটি কেটে ফেলে দিতেন তাহলেও বোধ হয় মেয়েটি একটু শান্তি পেত, চলাফেরা করতে পারত। ’ তবে চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কমতি নেই মুক্তামণির পরিবারের। চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে মুক্তার বাবা বলেন, তারা (চিকিৎসক) তো যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। হলো না। তা কি করা যাবে। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ যদি ভাল করেন, তাহলে ভাল হবে। অন্যদিকে. মুক্তামণি কবেনাগাদ আবার আসবে জানতে চাইলে বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্তলাল সেন বলেন, মুক্তামণির বাবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখেছি। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর সর্বদা রাখা হচ্ছে। শীত কমলেই ঢাকায় তাদের ডেকে আনা হবে।’ মুক্তার গোসল, খাওয়া সম্পর্কে তার বাবা বলেন, যে অবস্থা তাতে প্রতিদিন গোসল করানো যায় না। তিন চার দিন পরপর গোসল করানো হয়। সে স্বাভাবিক খাবাব খায়। যখন যা খেতে চায় তাই এনে খাওয়াচ্ছি। তবে কারো তুলে খাওয়ানো লাগে না। নিজেই বাঁ হাত থেকে তুলে খেতে পছন্দ করে। তিনি বলেন, মুক্তার জন্য সকলে দোয়া করবেন। আপনারা সবাই ওর জন্য দোয়া করেন, তা আমি জানি।’ মুক্তামণি সাতক্ষীরার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামারপাশা গ্রামের মোঃ ইব্রাহিম হোসেন ও আসমা খাতুনের সন্তান। হীরামণি নামে মুক্তামণির আধাঘণ্টার বড় যমজ বোনটি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে। সে সুস্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মুক্তামণিকে রোগ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। মুক্তামণিকে গত ১১ জুলাই ঢামেকের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় এটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। গত ২৫ জুলাই ঢামেকের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেনকে খবর দিয়ে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মুক্তামণির সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। সব শুনে প্রধানমন্ত্রী মুক্তামণিকে প্রয়োজনে বিদেশ নেয়ার নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে ওই দিনই ঢামেকের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ই-মেইল করে মুক্তার বিষয়টি জানানো হয়। ২৭ জুলাই প্রায় এক ঘণ্টার ভিডিও কনফারেন্সে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা মুক্তামণিকে দেখেন। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টগুলোও দেখানো হয়। সব কিছু দেখে তারা পরে আলোচনা করে জানানোর কথা বলেন। এরপর তারা ই-মেইল করে জানিয়েছেন, মুক্তামণির রোগ আরোগ্যযোগ্য বা দেহে অস্ত্রোপচার করার মতো নয়। পরবর্তীতে ৩ আগস্ট ঢামেক পরিচালকের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ঝুঁকি হলেও সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করে মুক্তামণিকে সুস্থ করার জন্য ঢামেকের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। ৫ আগস্ট বায়োপসি করা হয়। ৮ আগস্ট বায়োপসির রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে পেয়ে চিকিৎসকরা জানান, মুক্তামণির শরীরে ক্যান্সার ছড়ায়নি। সে বিরল রোগেও আক্রান্ত নয়। মুক্তামণি রক্তনালীর টিউমারে আক্রান্ত। এরপর ১২ আগস্ট তার দেহে প্রথম দফায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ঢামেকে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার দেহে সাত থেকে আট দফায় অস্ত্রোপচার করা।
×