ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জরুরী সভার সিদ্ধান্ত

বিজেএমসিতে ৩ উপদেষ্টা নিয়োগ কেলেঙ্কারি তদন্ত করবে মন্ত্রণালয়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

বিজেএমসিতে ৩ উপদেষ্টা নিয়োগ কেলেঙ্কারি তদন্ত করবে মন্ত্রণালয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিতর্কের মুখে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে তিন উপদেষ্টা নিয়োগের কেলেঙ্কারি তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, মামলা, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আপত্তি, গোয়েন্দা সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে রবিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরী সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিজেএমসির নিয়োগ সরকারী বিধি-বিধান মেনে হয়েছে কিনা তা নিজেরা পর্যালোচনা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবে। এদিকে সভায় বিজেএমসির চেয়ারম্যান নিজেদের অবস্থানকে ‘বিধিসম্মত’ বলে দাবি করার চেষ্টা করলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসহ সঠিক আইনী ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দুর্নীতি ও অনিয়মের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে নিয়ে অনুষ্ঠিত এ সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হচ্ছে না মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির কর্মকর্তারা। তবে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ ফয়জুর রহমান চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, হ্যাঁ নিয়োগ নিয়ে কথা উঠেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে। আমরা সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি মন্ত্রণালয় নিজেরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে। বিজেএমসি যে নিয়োগ দিয়েছে তা আইন বিধিসম্মত হয়েছে কিনা, নিয়োগ রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন মেনে হয়েছে কিনা- এসব দেখে আমরাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানাব। তবে সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া প্রতিবেদন সম্পর্কে সচিব বলেছিলেন, হ্যাঁ নিয়োগে সমস্যা হয়েছে। অভিযোগ আছে। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও আমরা পেয়েছি। বিজেএমসিকে প্রতিবেদনের বিষয়টি জানিয়েছি। আমরা এ্যাকশনে আছি। আর ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজেএমসির সচিব মোঃ সালাউদ্দিন বলেছিলেন, ‘দেখেন আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অনুসারে নিয়োগ দিয়েছি। হয়ত সমস্যা আছে। কিন্তু আমরাইতো নিয়োগ দিয়েছি। যদি অবৈধই হয় তাহলে তো আমরা তা বলতে পারি না। যেহেতু আমরাই নিয়োগ দিয়েছি।’ বিজেএমসির চেয়ারম্যান ড. মোঃ মাহমুদুল হায়দার নিয়োগের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন, ‘বিজেএমসির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থে তিনজনকে পিআরএলে যাওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদে গৃহীত হয়েছে।’ রবিবারের সভা শেষে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, বিজেএমসির চেয়ারম্যান, সচিব থেকে শুরু করে তিন উপদেষ্টাই বিভিন্ন চিঠি এমনকি গণমাধ্যমের কাছেও দাবি করেছেন মন্ত্রণালয় নাকি তাদের নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কথাটা মিথ্যা বলে প্রমাণ মিলেছে। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ আকারে তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা নিয়োগে কোন অনুমোদন দেয়নি। বিজেএমসি অনুমোদনের জন্য চিঠি দিয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিধি-বিধান মেনে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছিল। বিধিতে না থাকলে নিয়োগের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। এদিকে রবিবারের সভায়ও চেয়ারম্যান বিধি মেনে নিয়োগের দাবি করলেও জানা গেছে, বার বার বিজেএমসি এ নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ১৯৭২ সালের পিও-২৭ এবং ২০০৯ সালের পিও-০৭ এর বিধান টেনে আসছে। অথচ বিজেএমসির আইন উপদেষ্টা সরকারের আইন-কানুন ঘেটেই তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ‘উপদেষ্টাদের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান অত্র আইনে নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের কর্মচারী প্রবিধানমালা ১৯৯০ এর ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, অবসর গ্রহণ এবং উহার পর পুনঃনিয়োগের বিষয়ে কোন কর্মচারী ১৯৭৪ সালের পাবলিক সার্ভেন্টস রিটায়ারমেন্ট এ্যাক্টের বিধানাবলী দ্বারা পরিচালিত হবেন। অত্র আইনের ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত কোন গণকর্মচারী কোনভাবেই প্রজাতন্ত্রের অথবা কর্পোরেশনের জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চাকরিতে কোন প্রকারেই পুনরায় নিয়োজিত হইতে পারবেন না। এছাড়া সম্প্রতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সকল আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিন উপদেষ্টা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পিআরএলে থাকা অবস্থায় তিন কর্মকর্তার পাটকল কর্পোরেশনের উপদেষ্টা নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। সংস্থার প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে জমা দেয়া হয়েছে। ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে পিআরএলে থাকা অবস্থার একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলাম (যুগ্ম-সচিব), বাবুল চন্দ্র রায় (যুগ্ম-সচিব) দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে একই সঙ্গে বেতন গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়মের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ এ শিরোনামে বলা হয়েছে, নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের অর্গানোগ্রামে উপদেষ্টার কোন পদ নেই এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ পদ অনুমোদিতও নয়। কলকারাখানা পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে জারি করা প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং ২৭ এর ১৬ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার করে উক্ত তিনজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বেই কাদের নিয়োগ করা হবে তা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়, যা চরম অনিয়ম। বেআইনী নিয়োগের চিত্র তুলে ধরে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারী কর্মচারী (অবসর) আইন ১৯৭৪ এর ৪ ধারা অনুসারে পিআরএলরত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যতীত কোন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কোন পদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু উক্ত তিন কর্মকর্তা কোন অনুমতি ছাড়াই সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন ও সম্মানী গ্রহণ করছেন। প্রতিবেদনে তিন কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, উক্ত তিন কর্মকর্তার মধ্যে একেএম নাজমুজ্জামান ও বাবুল চন্দ্র রায় আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও সিরাজুল ইসলাম বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তা। তবে তিনজনই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাজনক পদে পদায়ন পেয়েছেন। একেএম নাজমুজ্জামান পাট ক্রয়ের সময় নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। তারা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে বিজেএমসি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল।
×