ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দশম জাতীয় সংসদ পাঁচ বছরে পদার্পণ করছে আজ

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

দশম জাতীয় সংসদ পাঁচ বছরে পদার্পণ করছে আজ

সংসদ রিপোর্টার ॥ ঘটনাবহুল দশম জাতীয় সংসদ চার বছর পূর্ণ করে পাঁচ বছরে অর্থাৎ শেষ বছরে আজ সোমবার পদার্পণ করছে। বিএনপির বর্জনের মুখে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যাপক নাশকতা-অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ১৩ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের পথচলা শুরু হয়। কোন কারণে রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙ্গে না দিলে আগামী বছর ২৯ জানুয়ারি শেষ হবে আলোচিত এ সংসদের মেয়াদ। তবে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে মেয়াদ-অবসানে ভেঙ্গে যাওয়া এ সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। আর চলতি অধিবেশনেই দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবে এই সংসদ। আজ সমাপনী বছরে পদার্পণ করবে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করা পাঁচ বছর মেয়াদী এই আইন সভা। সরকার ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিন্ন কণ্ঠে বলা হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ গঠিত না হলে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাই শুধু ধ্বংস হতো না, দেশে অসাংবিধানিক সরকারের আসার পথ সুগম হতো। তারা দশম জাতীয় সংসদকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সমুন্নত রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেও অভিহিত করেছেন। সরকার ও বিরোধী দল বলছে, বর্তমান সংসদে গত চার বছরে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে আলোচনায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ অধিবেশনগুলোতে আগের যে কোন সময়ের থেকে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেয়ায় সমগ্র সংসদ একই সুরে প্রশংসা করেছে। সংসদে সর্বসম্মত ধন্যবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিল দশম সংসদ। সংসদে এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিল পাস, প্রশ্নোত্তরসহ অন্যান্য ইস্যুতেও সক্রিয় ছিলেন সংসদ সদস্যরা। সর্বশেষ চার লাখ কোটি টাকার বাজেট পাস করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এই সংসদ। যে কারণে অতীতের যে কোন সময়ের থেকে এই সংসদ অনেক বেশি কার্যকর বলে মনে করেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। একই অভিমত সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদেরও। সংবিধান অনুযায়ী, আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। একইসঙ্গে সরকার নির্বাহী ক্ষমতা হারাবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে অর্থাৎ আগামী অক্টোবরের পর যে কোন দিন ওই তফসিল ঘোষণা করতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তখন সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তাদের করতলে চলে যাবে। এই সময়ে বিচার বিভাগও নোটিস বা শুনানির সুযোগ না দিয়ে তাদের ব্যাপারে কোন অন্তর্বর্তী আদেশ বা নির্দেশ জারি করতে পারবে না। যাত্রা শুরুতেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ॥ যাত্রা শুরুর মাত্র নয় মাসের মধ্যেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে বর্তমান সংসদ। এতে দেশের প্রথম (১৯৭২ সালের) সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে নেয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে এই সংশোধনী বাতিল করে দেয় উচ্চ আদালত। এ বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ রায়ে বর্তমান সংসদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলে পর বিচার, নির্বাহী ও আইন বিভাগের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এরই জেরে প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ ঘোষণা, তার ছুটির আবেদন, বিদেশ গমন, পদত্যাগ, দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন ইস্যু আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ত্রিমুখী অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে। চার বছরে মোট ১৩০টি আইন পাস ॥ সংসদের আইন শাখা জানায়, এই চার বছরে চলমান অধিবেশনসহ ১৯টি অধিবেশন বসেছে। আর কার্যদিবস ছিল ৩৪২টি। ৪টি বাজেট পাস করেছে সংসদ। প্রথম অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৩৬টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১৪টি, চতুর্থ অধিবেশনে ১০টি, পঞ্চম অধিবেশনে ৩৯টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ২৬টি , সপ্তম অধিবেশনে ৮টি, অষ্টম অধিবেশনে ১২টি, নবম অধিবেশনে ২৭টি, দশম অধিবেশনে ৯টি, একাদশ অধিবেশনে ৩২টি, ১২তম অধিবেশনে ১০টি, ১৩তম অধিবেশনে ৫টি, ১৪তম অধিবেশনে ৩২টি, ১৫তম অধিবেশনে ৫টি, ১৬তম অধিবেশনে ২৪টি, ১৭তম অধিবেশনে ৫, ১৮তম অধিবেশনে ১০ ও চলতি ১৯তম অধিবেশনে রবিবার পর্যন্ত ১৫ কার্যদিবস চলেছে। এই চার বছরে মোট ১৩০টি আইন পাস হয়েছে। এসব আইনগুলোর মধ্যে অনেক নতুন, মৌলিক ও সংস্কারমূলক আইনও রয়েছে। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ ১৬টি অধিবেশন শেষ করেছে। আর বর্তমানে শীতকালীন অধিবেশন চলছে। সংসদের রেকর্ড যাচাই করে দেখা গেছে, চলতি বছরের এসব বিলের অধিকাংশই পাস হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি। বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বার বার সর্বোচ্চ দশজন এমপিকে অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে বেশির ভাগ সময় তাদের দেয়া সংশোধনী গৃহীত হয়নি। আইন প্রণয়নের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এবার সংসদে সংবিধানের ১৬তম সংশোধন আইন পাস করা হয়। তাছাড়াও আরও বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়। এ আইনগুলোর মধ্যে প্রথম অধিবেশনে ২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ৬টি, তৃতীয় অধিবেশনে ৫টি, চতুর্থ অধিবেশনে ৬টি, পঞ্চম অধিবেশনে ৮টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ৫টি, সপ্তম অধিবেশনে ৬টি, অষ্টম অধিবেশনে ১০টি, নবম অধিবেশনে ৯টি, দশম অধিবেশনে ১৪টি, একাদশ অধিবেশনে ১৬টি, ১২তম অধিবেশনে ৬টি, ১৩তম অধিবেশনে ৫টি, ১৪তম অধিবেশনে ৬টি, ১৫তম ২টি, ১৬তম অধিবেশনে ৭টি, ১৭তম অধিবেশনে ২টি, ১৮তম অধিবেশনে ৩ টি ও চলতি ১৯তম অধিবেশনে রবিবার পর্যন্ত ৯টি আইন পাস হয়েছে। সারাবিশ্বের সমর্থন ও সুনাম অর্জন ॥ নির্বাচন নিয়ে বর্জনকারী দল বিএনপি দশম জাতীয় সংসদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও গত চার বছরে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বর্তমান সংসদ সারাবিশ্বেরই সমর্থন ও সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সরকারের ইতিবাচক অর্জনে প্রাণবন্ত আলোচনায় বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি ছিল নজরকাড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী-তনয়া সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকীর সাফল্য অর্জন, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায় বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের দেয়া ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রদান ছিল অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ যুক্ত হওয়ায় সংসদে ধন্যবাদ প্রস্তাবও গৃহীত হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব ছিল সিপিএ সম্মেলন ॥ কমনওয়েথভুক্ত দেশগুলোর সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের ৬৩তম সাধারণ সম্মেলনও দারুণ দক্ষতা ও সুনিপুণভাবে শেষ করে জাতীয় সংসদ। সম্মেলনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্তভাবে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে একটি বিবৃতি গৃহীত হয়েছে। এছাড়া এই সম্মেলনে পরবর্তী তিন বছরের জন্য সিপিএ নতুন চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। দেশের বর্তমান আইনসভা একইসঙ্গে সিপিএ ও আইপিইউ-এর নেতৃত্ব দিয়ে ‘বিরল দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছে উল্লেখ করে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদের চতুর্থ বছরটি-কে ‘সংসদীয় কূটনীতির মাইলফলক’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে যারা সমালোচনা করেন, এই সংসদের সফলতা তাদের মুখে চপেটাঘাত করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।’ স্পীকার বলেন, ‘আমার মনে হয় সরকারী ও বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দশম সংসদ একটি কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। যা দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এক প্রশ্নের জবাবে স্পীকার বলেন, ‘বিগত চার বছরে বিরোধী দল প্রতিটি অধিবেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। কোন কোন ইস্যুতে তারা ওয়াক-আউট করেছেন। এই ওয়াক-আউট সংসদীয় রীতির মধ্যে একটি বিষয়। তারা যখন কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে চেয়েছেন, তখনই তারা ওয়াক-আউট করেছেন।’ সংসদে সরব বিরোধী দলের দাবি ॥ এদিকে চার বছর পূর্তিতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দাবি তারা সরব ছিলেন সংসদে। বিগত বছরগুলোতে হাতেগোনা কয়েকবার সংসদ বর্জন (ওয়াকআউট) করেছিল বিরোধী দল। সর্বশেষ চলতি অধিবেশনে ব্যাংক কোম্পানি আইন পাসের প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন তারা। জাতীয় নির্বাচনের এ বছরের শুরু থেকেই অবশ্য সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিরোধী দল। বিশেষ করে ব্যাংক খাত নিয়েই তারা সংসদ গরম করছে বার বার। প্রতিটি বিল উত্থাপন ও পাসের সময় তাদের রুটিন বিরোধিতাও অব্যাহত রয়েছে। এর আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০১৫ সালে তারা প্রথমবার সংসদ বর্জন করেছিল। বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের আক্রমণে রীতিমতো বিব্রত হয়েছের একাধিক মন্ত্রীরা। জাতীয় সংসদের চার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, জাতীয় পার্টি সংসদে ও সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে দলটি ভূমিকা রেখেছে। আমরা সুস্থ ধারার রাজনীতি ও দেশের স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। জাতীয় পার্টি সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি পাল্টে দিয়েছে। জনগণের স্বার্থে জাতীয় সংসদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
×