ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার রায় ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিএনপি নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:০২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

খালেদার রায় ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিএনপি নেতারা

শরীফুল ইসলাম ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় ঘোষণা হলে সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচী পালন শুরু করবে বিএনপি। হরতাল-অবরোধসহ লাগাতার আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলেও কৌশলগত কারণে আগাম ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। তবে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এ রায়ের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের পাশাপাশি এ কর্মসূচী ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। জোরদার আন্দোলন কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের চেষ্টা করবে দলটি। ইতোমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের এমন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। জানা যায়, সর্বশেষ বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও খালেদা জিয়ার মামলা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ সময় খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হলে কঠোর আন্দোলনে নামার পাশাপাশি তাকে (খালেদা জিয়াকে) ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর আন্দোলনে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে রায় ঘোষণার আগেই খালেদা জিয়া জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ম বিনিময়ের পাশাপাশি বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেন। আন্দোলনের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর পর তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর, আশপাশের জেলা নেতা ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করবেন। এ ছাড়া তিনি জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন এবং আন্দোলন কর্মসূচীর কৌশল নিয়ে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা হলেও এখনই তা বলা যাবে না। আমরা আশঙ্কা করছি, খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে তাকে জেলে পাঠানো হতে পারে। তবে মামলার রায় কি হয় আমরা আগে তা দেখতে চাই। তাই খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার পর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। আর কর্মসূচী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এবার সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে আসবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার জেল হলে দল কিভাবে চলবে এ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ তারেক রহমান অথবা তার স্ত্রী ডাঃ জোবাইদা রহমানকে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা প্রস্তাব করলেও খালেদা জিয়া এতে সায় দেননি বলে জানা যায়। খালেদা জিয়া এ প্রসঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, যদি আদালতে আমার বিরুদ্ধে মামলায় কোন নেতিবাচক রায় আসে এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে জেলে যেতে হয় তাহলে ড. মোশাররফ ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ দলে যারা সিনিয়র আছেন তাদের সহযোগিতা নিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কোন অবস্থায় যেন দলে বিশৃঙ্খলা না হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে সমন্বয় করার কথাও বলেন খালেদা জিয়া। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সম্প্রতি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্পর্কে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতিবাচক সমালোচনা প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, কেন রিজভী দলের মহাসচিব সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলবে। ভবিষ্যতে এমনটি যেন আর না হয়। দলের মধ্যে সবাইকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। কেউ শৃঙ্খলা ভাঙ্গার চেষ্টা করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মামলার রায়ের কারণে জেলে যেতে হলে বিভিন্ন মহল থেকে দল ভাঙ্গার চেষ্টা হতে পারে আশঙ্কা করে খালেদা জিয়া সবাইকে সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেন। এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মামলার শাস্তি থেকে রক্ষা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয় সে লক্ষ্য সামনে রেখে আবারও কূটনীতিক তৎপরতা জোরদার করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে বিএনপির। বৈঠকে প্রায় ১০০ দেশের কূটনীতিক এবং ২০টি বিদেশী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ বৈঠকে খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাকর্মীদের মামলা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত থেকে বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যেই বিএনপির কূটনৈতিক সেল গঠন করা হয়েছে। এ সেলে কাজ করছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. আব্দুল মঈন খান, দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাাদক মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, সহআন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরীন মুন্নী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাসহ অনেকে। উল্লেখ্য, ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় হওয়ার তারিখ নির্ধারিত। বিশেষ কোন কারণ না থাকলে ওইদিনই রায় হবে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে জেলে পাঠানো হতে পারে। আর এ আশঙ্কার কারণে বিএনপিও নড়েচড়ে বসেছে। খালেদা জিয়া জেলে গেলে কি করতে হবে এমন প্রস্তুতি নিয়েও দলের সর্বস্তরের নেতারা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। শনিবার রাত ৯টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত গুলশান কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় খালেদা জিয়ার বিপক্ষে যাবে এমনটা ধরে নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়া জেলে গেলে পরবর্তী করণীয় কি হবে এ নিয়েই আলোচনা হয়। এ সময় খালেদা জিয়া নিজেও সিনিয়র নেতাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অধিকাংশ নেতা খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হলে হরতাল ও অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। আর খালেদা জিয়াও আন্দোলনের পক্ষে সায় দেন। তবে তিনি এও বলেন, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের আন্দোলন কেন ব্যর্থ হলো সেখান থেকে শিক্ষা না নিলে আন্দোলন সফল করা যাবে না। তাই তিনি আন্দোলন কর্মসূচীর আগে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপির সর্বস্তরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা জানান। সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে আন্দোলনের মাঠে নামলে তা সফল হবে বলেও তিনি জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলের বিভিন্ন স্তর থেকে রাজপথে আন্দোলনে নামার দাবিও উঠছে। তবে আন্দোলন শুরু হলে সরকার কঠোর হস্তে তা দমনের চেষ্টা করবে এমন ভাবনা থেকেই দলীয় হাইকমান্ড আন্দোলনে নামার আগে নানামুখী কৌশল ঠিক করে নিচ্ছেন। তবে রায়ের তারিখ ঘোষণার পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। রায় ও আন্দোলনের আগে গ্রেফতার হতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে কেউ কেউ আবাসস্থলও পরিবর্তন করেছেন। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা দফায় দফায় বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের মধ্যে বৈঠকও করছেন। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি রাজপথে আন্দোলনে নামলে সরকারী দল আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামবে। এ ছাড়া সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কঠোর হস্তে তা দমনের চেষ্টা করবে এসব কিছু মাথায় রেখেই বিএনপিকে আন্দোলনের ছক সাজাতে হচ্ছে। এ নিয়ে দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, আগের আন্দোলনের ব্যর্থতা ও এবার কি হতে পারে সব সম্ভাবনা সামনে রেখেই কর্মসূচী ঠিক করা হচ্ছে। বিএনপিকে আর চুপ থাকলে হবে না। আন্দোলন করেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে। সরকারই বিএনপিকে আন্দোলনে যেতে বাধ্য করছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোর রায় দেয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর আন্দোলন শুরু হবে। এবার আন্দোলন শুরু হলে সরকারের পতন না ঘটিয়ে আমরা ঘরে ফিরব না। আর এবার আমরা খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করব না। কারণ, এ সরকারের কাছে মুক্তি দাবি করে লাভ হবে না। সরকারের পতন ঘটিয়ে আমরা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচনে যাব। জনগণের রায় নিয়ে আবারও আমরা ক্ষমতায় যাব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় হলে দুর্বার আন্দোলন শুরু হবে। আর এ আন্দোলনে সরকার পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সারাদেশে আন্দোলন শুরু হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এত তাড়াতাড়ি খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ নিয়ে জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যায়ভাবে খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেয়া হলে বা জেলে নেয়া হলে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে বসে থাকবে না। রাজপথে কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে। আর এ আন্দোলনেই বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক রায় দিলে সারাদেশে গণআন্দোলন শুরু হবে। আর এর দায় বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। দেশে এমন আন্দোলন শুরু হবে যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মতো বর্তমান সরকারকেও ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। এর পর সরকারী দলের লোকেরা পালানোর পথও পাবে না।
×