ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করবে ঢাকা-জাকার্তা, এলএনজি আমদানি ও ৫ সমঝোতা স্মারকসহ ১৯ দফা যৌথ ঘোষণা

দ্রুত সমাধান চাই ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রশ্নে ইন্দোনেশিয়া

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

দ্রুত সমাধান চাই ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রশ্নে ইন্দোনেশিয়া

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ঢাকা-জাকার্তা একযোগে কাজ করবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিসহ ৫টি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ। উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে ১৯ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট রবিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো শনিবার তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। সফরের দ্বিতীয় দিন রবিবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে সাভার স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেন্ট। দুপুরে তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। বিকেলে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে দুই দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের বরাত দিয়ে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরী। মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যই বাংলাদেশ ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এই সফর করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, নিঃসন্দেহে এটি মিয়ানমারের ওপর একটি চাপ। আমি মনে করি, বাংলাদেশে আসিয়ান সদস্যভুক্ত কোন সরকারপ্রধানের সফর ও রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা একটি বড় ধরনের ইস্যু। শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে কূটনৈতিক সমর্থন চাইছে। জাকার্তা ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি ইন্দোনেশিয়া এই ইস্যুতে আমাদের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যহত রাখবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মিয়ানমার থেকে সহিংসতার কারণে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া ও তাদের থাকা-খাওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থা করার জন্য ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলাপের মধ্যে যে জিনিসটা বিশেষভাবে উঠে এসেছে সেটা হলো- দুজনই স্বীকার করেছেন যে, অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি হয়নি। ১৯ দফা যৌথ ঘোষণা ॥ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর ঢাকা সফর উপলক্ষে রবিবার ১৯ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করবে। এ লক্ষ্যে জ্বালানি, বাণিজ্য, বেসরকারী খাতে বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উপাদান নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছে এই দুই দেশ। এছাড়াও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার মতো বিষয়গুলো নিয়েও দেশ দু’টি যৌথভাবে কাজ করবে। ১৯ দফা যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, উভয় দেশের জন্য লাভজনক এমন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য দুই দেশ একমত হয়েছে। জ্বালানি খাতে সমৃদ্ধ ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ বড় পরিসরে কাজ করতে আগ্রহী। এরই মধ্যে জাকার্তা থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার জন্য চুক্তিও করেছে ঢাকা। আবার দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদেরও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য আলোচনা শুরু করতে বলা হয়েছে। যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন তার নেতৃত্বেই আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। ৫ সমঝোতা সই ॥ বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য, কূটনীতি, মৎস্য খাত এবং জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ৫টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দু’নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর সফররত ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এই সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়। দু’নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে দু’দেশের মধ্যে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা সংক্রান্ত সমঝোতা, দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক আয়োজনে সমঝোতা, মৎস্যসম্পদ আহরণ সংক্রান্ত বিষয়ে যৌথ সম্মতিপত্র, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনালের অবকাঠামো উন্নয়ন ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন ॥ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানিয়েছেন বাংলাদেশে সফররত ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রবিবার সকালে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান জোকো উইদোদো। এ উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকের সামনে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ ও উইদোদোর দু’টি বড় ছবি স্থাপন করা হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মোটরশোভাযাত্রা নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছুলে জোকো উইদোদোকে স্বাগত জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ডাঃ এনামুর রহমান। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। এসময় তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। জোকো উইদোদো কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসময় উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। পরে তিনি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি বকুল গাছের চারা রোপণ করেন। সাভার থেকে ফিরে তিনি ধানম-ির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় তিনি জাদুঘর ঘুরে দেখেন। এছাড়া সেখানে শোক বইতে স্বাক্ষর করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
×