ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেরেবাংলায় সিংহের গর্জন- শিরোপা শ্রীলঙ্কার

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

শেরেবাংলায় সিংহের গর্জন- শিরোপা শ্রীলঙ্কার

মিথুন আশরাফ ॥ ‘শিরোপা জিততে উদগ্রীব আমরা।’ ফাইনালের আগে বলেছিলেন বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারলেই যে প্রথমবারের মতো কোন টুর্নামেন্ট বা সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করত বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়ত। কিন্তু শ্রীলঙ্কা তা হতে দিল না। শ্রীলঙ্কার কাছে উল্টো হারল ৭৯ রানে। এই হারে বাংলাদেশের ইতিহাস গড়া হলো না। ত্রিদেশীয় সিরিজে শিরোপা জিতে নিল শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল। যে দলটি প্রথম দুই ম্যাচে বিধ্বস্ত হয়ে জিম্বাবুইয়ে ও বাংলাদেশের মতো দলের বিপক্ষে হেরেছে; সেই দলটিই কিনা টানা তিন ম্যাচ জিতে নিল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে জেতার পর থেকেই ঘুরে দাঁড়াল। এরপর বাংলাদেশকে হারাল। ফাইনালেও বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো। বাংলাদেশের সাবেক কোচ, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে যেন দেখিয়ে দিলেন তিনি কি জিনিস। যে দলই তার হাতে পড়ুক, সেই দলকেই সাফল্য এনে দিতে পারবেন। তাইতো চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত হতেই মুখে হাসি লেগেই থাকে তার। প্রথম তিন ম্যাচে যে ব্যাটসম্যানরা দুর্বার ছিলেন। পরের দুই ম্যাচেই তারা ফ্লপ। যেন ব্যাটিংই করতে ভুলে গেছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। শ্রীলঙ্কার বোলারদের সামনে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করতে থাকেন যেন ব্যাটিংই করতে পারেন না। ২২ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। সাকিব ইনজুরিতে ব্যাটিং করতে পারবেন না। তা আগেই জানা হয়ে যায়। তাই শুরুতে তামিম ইকবালকেই যা করার করতে হবে। এমন অবস্থায় ১১ রানেই তামিম (৩) আউট হয়ে যান। দেখতে দেখতে বিজয়ের পরিবর্তে ওপেনিংয়ে খেলার সুযোগ পাওয়া মোহাম্মদ মিঠুন (১০) ও সাকিবের পরিবর্তে তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা সাব্বির রহমানও (২) ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে সাজঘরে ফেরেন। এরপর মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মিলে ভরসা দিচ্ছিলেন। দুইজন মিলে দলকে ৮০ রানেও নিয়ে যান। কিন্তু এমন সময়ই স্পিনার ধনঞ্জয়ার বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে আউট হয়ে যান মুশফিক (২২)। বাংলাদেশের আশা-ভরসাও যেন শেষ হয়ে যায়। মাহমুদুল্লাহ ছাড়া ম্যাচ জেতানোর মতো ব্যাটসম্যান যে ছিলেন না। মিরাজ এসেতো অহেতুক আউট হলেন। মাহমুদুল্লাহ উইকেট আঁকড়ে থাকেন। ৩২তম ওভারে গিয়ে দলের ১০০ রানও হয়। মাহমুদুল্লাহও ছক্কা হাঁকিয়ে হাফ সেঞ্চুরি করেন। এক মাহমুদুল্লাহই তখন ভরসা হয়ে দাঁড়ান। সাইফউদ্দিন সঙ্গটা ভালই দিচ্ছিলেন মাহমুদুল্লাহকে। কিন্তু ১২৭ রান হতেই রানআউট হয়ে যান। এরপর মাশরাফি এসেও দ্রুতই সাজঘরে ফিরলেন। মুহূর্তেই রুবেলও বোল্ড হয়ে গেলেন। ১৪২ রান হতে ৭৬ রান করা মাহমুদুল্লাহও আউট হয়ে গেলেন। মাহমুদুল্লাহকে আউট করে দিলেন মাদুশঙ্কা। যার এই ম্যাচেই অভিষেক হয়েছিল। আর অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে দেখালেন মাদুশঙ্কা। আগের ওভারে শেষ দুই বলে মাশরাফি ও রুবেলকে আউট করেন। পরের ওভারের প্রথম বলে মাহমুদুল্লাহকে আউট করে দিয়ে হ্যাটট্রিক করেন মাদুশঙ্কা। তাতে বাংলাদেশের ইনিংসও শেষ হয়ে যায়। কারণ সাকিব যে ব্যাট করতে পারেননি। শুরুতেই গুনাথিলাকাকে আউট করে দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু এরপরই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। কুশল মেন্ডিস ব্যাট হাতে নেমে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন। এমনই ব্যাটিং করেন, মিরাজের তৃতীয় ওভারে দুই ছক্কা, দুই চার হাঁকান। ওভারটিতে মিরাজ ২৪ রান দেন। ২৩ রানই নেন মেন্ডিস। ৬ ওভারেই ৪২ রানে চলে যায় লঙ্কানরা। এমন সময় মেন্ডিসকে (৯ বলে ২ চার ৩ ছক্কায় ২৮) আউট করে দেন মাশরাফি। মেন্ডিসের আউটের পরও তৃতীয় উইকেটেও দেখা গেল বড় জুটি গড়ার দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে শ্রীলঙ্কা। ওপেনার উপুল থারাঙ্গা ও নিরোশান ডিকভেলার উইকেট একটা সময় শিকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। থারাঙ্গা ও ডিকভেলা মিলে দলকে ১০০ রানের ওপরেও নিয়ে যান। ২২ ওভার না হতেই ১০০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হয়ে যায়। সঙ্গে উইকেটও মজবুত থাকে। তাতে শ্রীলঙ্কার হাতে ম্যাচের ‘বাটন’ও থাকে। এমন যখন পরিস্থিতি মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের দুর্দান্ত একটি বলে আউট হন ডিকভেলা (৪২)। থারাঙ্গার সঙ্গে ৭১ রানের জুটি গড়া ১১৩ রানে গিয়ে ডিকভেলা আউট হওয়ার পরও থেমে থাকেনি শ্রীলঙ্কা। উইকেট পড়লেও বিপদে পড়েনি। থারাঙ্গা যে উইকেটে সেট হয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে দিনেশ চান্দিমালও যে দুর্দান্তভাবে ব্যাটিং করতে থাকেন। দেখতে দেখতে ৩৩ ওভারে গিয়ে ১৫০ রানও করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। ৩ উইকেট হারিয়ে হাতে ১৫ ওভার থাকতে ১৫০ রান করা মানে অনেক বড় স্কোর। যে স্কোর শেষে গিয়ে ৩০০ রানের কাছাকাছিও যেতে পারে। ২৮০ রানে যদি চলে যায় শ্রীলঙ্কা তাহলে বিপদ বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। এমন সময় মুস্তাফিজুর রহমান নিজের বোলিং ঝলক দেখিয়ে দেন। ১৫৮ রান হতেই ৩০ ও ৩৯ রানের সময় সাকিবের বলে ক্যাচ আউট হওয়া থেকে দুইবার বাঁচার পর হাফ সেঞ্চুরি করা থারাঙ্গাকে (৫৬) লো বল দিয়ে বোল্ড করে দেন। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুস্তাফিজ উইকেটটি শিকার করেন। এ উইকেট পেয়ে দেশের হয়ে সবচেয়ে কম ম্যাচ (২৭ ম্যাচ) খেলে ৫০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখান মুস্তাফিজ। এবার বিপত্তিতে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কাও। ১৬৩ রান হতে যখন থিসারা পেরেরাকে (২) আউট করে দেন রুবেল হোসেন, তখন তো শ্রীলঙ্কার ২০০ রান করাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ৫ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা এমন বেহাল দশাতেই পড়ে, নিচের সারির বাকি ব্যাটসম্যানদের কাজই হয়ে পড়ে পুরো ৫০ ওভার কোনমতে খেলা। এমন পরিস্থিতিতে গিয়ে ঘটে একটি অঘটন। যে অঘটন শ্রীলঙ্কাকে অনেকখানি এগিয়ে দেয়। ৪২ ওভারের প্রথম বলের সময় ১৭১ রানে সাকিব ইনজুরিতে পড়ে যান। মুস্তাফিজের বলে চান্দিমাল এক রান নিতে যান। সাকিব সেই বল ড্রাইভ দিয়ে ধরতে গেলে তাতেই বিপত্তি ঘটে। মাটিতে ঘর্ষণ খেয়ে তার বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ব্যথা পান। আঙ্গুল মচকে যায়। মাটিতে লুটিয়ে থাকেন সাকিব। পরে ফিজিও এসে তার হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হয় সাকিবকে। একটি সেলাইও লাগে। সাকিব ৫ ওভার করেছিলেন। দিয়েছিলেন ২০ রান। স্বাভাবিকভাবেই তখন সবার বোঝা হয়ে যায় সাকিব আর এই ম্যাচে বল হাতে নিতে পারবেন না। এমনকি তিনি ব্যাটিংও করতে পারবেন না। বাংলাদেশকে ৯ ব্যাটসম্যান নিয়েই খেলতে হবে। সেই সঙ্গে সাকিবের ৫ ওভারও অন্য কাউকে দিয়ে পুষিয়ে নিতে হবে। বোলিং-ব্যাটিং দুইদিক দিয়েই বাংলাদেশ বিপদে পড়ে গেল। এখন শ্রীলঙ্কা ২০০ রানের যত ওপরে রান করতে থাকবে বাংলাদেশের জন্য ম্যাচ থেকে ফল বের করে আনা ততই কঠিন হতে থাকবে। চান্দিমালও উইকেটে থাকেন। তাই লঙ্কানদের ভরসাও থাকে। যদি নিচের সারির ব্যাটসম্যানরা উইকেট আঁকড়ে থাকতে পারেন তাহলে চান্দিমাল রান বাড়িয়ে নিতে পারবেন। শ্রীলঙ্কা এই ফরমুলাতে সফলও হয়। তবে উইকেটও পড়তে থাকে। ১৮২ রানে গুনারতেœকে (৬) ও স্কোরবোর্ডে ২০০ রান হওয়ার পর আরও ৯ রান যোগ হতেই চান্দিমালকে (৪৫) বোল্ড করে দেন রুবেল। অসাধারণ বোলিং করতে থাকেন। যেন সাকিবের অভাব দূর করে দিতে থাকেন। ২১৭ রানে গিয়ে আকিলা ধনঞ্জয়াকে (১৭) মুস্তাফিজ আউট করার পর ২ রান যোগ হতেই অভিষিক্ত শেহান মাদুশঙ্কাকেও (৭) বোল্ড করে দেন রুবেল। চার উইকেট শিকার করে নেন। ২২১ রানে গিয়ে সুরঙ্গ লাকমাল (২) রানআউট হতেই শ্রীলঙ্কার ইনিংসও শেষ হয়ে যায়। ৫০ ওভারও খেলে লঙ্কানরা। যে রান করে তাতেই বাংলাদেশকে হারিয়ে শিরোপা জিতে যায় হাতুরাসিংহের শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা স্কোর কার্ড বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ফাইনাল টস ॥ শ্রীলঙ্কা (ব্যাটিং)। ভেন্যু ॥ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। শ্রীলঙ্কা ইনিংস রান বল ৪ ৬ গুনাথিলাকা ক তামিম ব মিরাজ ৬ ১১ ১ ০ থারাঙ্গা ব মুস্তাফিজ ৫৬ ৯৯ ৫ ০ মেন্ডিস ক মাহমুদুল্লাহ ব মাশরাফি ২৮ ৯ ২ ৩ ডিকভেলা ক সাব্বির ব সাইফউদ্দিন ৪২ ৫৭ ৪ ০ চান্দিমাল ব রুবেল ৪৫ ৭৪ ০ ১ পেরেরা ক তামিম ব রুবেল ২ ১০ ০ ০ গুনারতেœ এলবি. ব রুবেল ৬ ১৪ ০ ০ ধনঞ্জয়া ক মিঠুন ব মুস্তাফিজ ১৭ ১৬ ১ ১ মাদুশঙ্কা ব রুবেল ৭ ৬ ১ ০ লাকমাল রানআউট ২ ৪ ০ ০ চামিরা নটআউট ১ ২ ০ ০ অতিরিক্ত (লেবা ৫, নো ২, ও ২) ৯ মোট (অলআউট; ৫০ ওভার) ২২১ উইকেট পতন ॥ ১/৮ (গুনাথিলাকা), ২/৪২ (মেন্ডিস), ৩/১১৩ (ডিকভেলা), ৪/১৫৮ (থারাঙ্গা), ৫/১৬৩ (পেরেরা), ৬/১৮২ (গুনারতেœ), ৭/২০৯ (চান্দিমাল), ৮/২১৭ (ধনঞ্জয়া), ৯/২১৯ (মাদুশঙ্কা), ১০/২২১ (লাকমাল)। বোলিং ॥ মিরাজ ১০-০-৫৩-১, মাশরাফি ৭-০-৩৫-১, মুস্তাফিজ ১০-০-২৯-২, মাহমুদুল্লাহ ৪-০-১৮-০, সাইফউদ্দিন ৪-০-১৫-১, সাকিব ৫-০-২০-০, রুবেল ১০-০-৪৬-৪। বাংলাদেশ ইনিংস (টার্গেট ২২২ রান) রান বল ৪ ৬ তামিম ক ধনঞ্জয়া ব চামিরা ৩ ১৮ ০ ০ মিঠুন রানআউট ১০ ২৭ ০ ১ সাব্বির ক গুনারতেœ ব চামিরা ২ ৯ ০ ০ মুশফিক ক থারাঙ্গা ব ধনঞ্জয়া ২২ ৪০ ১ ০ মাহমুদুল্লাহ ক থারাঙ্গা ব মাদুশঙ্কা ৭৬ ৯২ ৬ ৩ মিরাজ ক এ্যান্ড ব ধনঞ্জয়া ৫ ১৪ ০ ০ সাইফউদ্দিন রানআউট ৮ ২৯ ০ ০ মাশরাফি ক মেন্ডিস ব মাদুশঙ্কা ৫ ১২ ০ ০ রুবেল ব. মাদুশঙ্কা ০ ১ ০ ০ মুস্তাফিজ নটআউট ০ ৫ ০ ০ সাকিব অনুপস্থিত অতিরিক্ত (বা ১, লেবা ৪, ও ৬) ১১ মোট (অলআউট; ৪১.১ ওভার) ১৪২ উইকেট পতন ॥ ১/১১ (তামিম), ২/১৭ (মিঠুন), ৩/২২ (সাব্বির), ৪/৮০ (মুশফিক), ৫/৯০ (মিরাজ), ৬/১২৭ (সাইফউদ্দিন), ৭/১৪১ (মাশরাফি), ৮/১৪১ (রুবেল), ৯/১৪২ (মাহমুদুল্লাহ)। বোলিং ॥ লাকমাল ৯-২-২৯-০, চামিরা ৮-১-১৭-২, পেরেরা ৭-০-৩১-০, মাদুশঙ্কা ৬.১-১-২৬-৩, ধনঞ্জয়া ৯-০-৩০-২, গুনাথিলাকা ২-১-৪-০। ফল ॥ বাংলাদেশ ৭৯ রানে পরাজিত। ম্যাচসেরা ॥ উপুল থারাঙ্গা (শ্রীলঙ্কা)। সিরিজ ॥ শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন। সিরিজ সেরা ॥ থিসারা পেরেরা (শ্রীলঙ্কা)।
×